উত্তর কন্নড় জেলার শারাভাথি নদীর পাশেই অবস্থিত গেরসোপ্পা। সেখানে গেলে একটা জায়গায় দেখতে পারবেন কিছু স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। সবুজ আগাছা, ঘাসের মাঝখান দিয়ে এখনও বেরিয়ে আছে ইতিহাসের একটি টুকরো। আজ থেকে বহু বছর আগে, এই জায়গাই ছিল এক রানির রাজধানী। না, রাজা নয়। একা হাতে, বীরত্বের সঙ্গে ৫৪ বছর দক্ষিণের একটা বড় অংশে চালিয়ে গেছেন রাজত্ব। তখনও রানী লক্ষ্মীবাঈ জন্ম নেননি। তাঁর জন্মের অন্তত ১০০ বছর আগেই রচিত হয়েছিল এক রানির বীরগাথা। তিনি, গেরসোপ্পার রানি চেন্নাভাইরা দেবী।
১৫৫২ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ— এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নারী ভারতে রাজ্য শাসন করেননি। যিনি করেছিলেন, তিনিই এই কাহিনির নায়ক। চেন্নাভাইরা দেবী ছিলেন দক্ষিণের সালুভা বংশের শাসক। প্রজাবৎসল, সংগ্রামী এক নেত্রী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, সাহসী। গোয়া থেকে কর্ণাটক, মালাবার অবধি বিস্তৃত ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। আজও গেরসোপ্পার ভগ্নস্তুপে গেলে সেখানকার নানা জায়গায় দেখা যাবে তাঁর ছোঁয়া। দেখা যাবে তাঁর বিশাল মীরজান দুর্গ, চতুর্মুখ জৈন মন্দির।
আরও পড়ুন
৬৭ বছর বয়সে, পর্তুগিজদের দেশছাড়া করেছিলেন আফ্রিকার ‘রানি লক্ষ্মীবাঈ’
এখানে উল্লেখ্য, তাঁর এই ৫৪ বছরের রাজত্বকালে গেরসোপ্পা দক্ষিণের অন্যতম বাণিজ্যের স্থান হিসেবে উঠে এসেছিল। নদী তীরবর্তী অঞ্চল হওয়ার জন্য বাণিজ্য বিস্তারের সুযোগও ছিল বিস্তর। আর এই সূত্র ধরেই আমাদের কাহিনিতে ঢুকে পড়বে পর্তুগিজরা।
১৫ শতকের শেষের দিক থেকে পর্তুগিজরা ভারতে তাঁদের বাণিজ্য বিস্তার করতে থাকে। তবে শুধু বাণিজ্য বিস্তার করেই ক্ষান্ত হননি তাঁরা। আর কী করেছিলেন, সেটার ধারণা আশা করি সবাই করতে পারবেন। নাহলে ইংরেজদের উদাহরণ তো হাতের সামনেই রয়েছে। যাই হোক, গেরসোপ্পায় পর্তুগিজরা আসবে, আর তাঁদের ‘কাহিনি’ রানি চেন্নাভাইরা দেবীর কাছে আসবে না, তা কি হয়? বিদেশি বণিকদের অত্যাচারের বর্ণনা সবই কানে এল রানির। আশ্রয় দিলেন প্রজাদের।
আরও পড়ুন
সাতবাহন রাজত্বকালে লেখা, উদ্ধার হল দক্ষিণ ভারতের প্রাচীনতম সংস্কৃত লিপি
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। স্থানীয় কেলাদি এবং বিলগিরা যোগ দিল শত্রু দলের সঙ্গে। এক সময়, দীর্ঘ ৫৪ বছরের আধিপাত্যের অবসান হল। রানী পরাজিত ও বন্দি হলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই বন্দি হয়েই ছিলেন নিজের হাতে গড়া রাজ্যে। কিন্তু সম্মান? না, সেটায় কোনও আঁচ পড়েনি। ইতিহাস তার গায়ে ঘাস গজাতে দেয়নি। স্বয়ং পর্তুগিজদের সমীহ আদায় করেছিলেন রানী চেন্নাভাইরা।
রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে ছিলেন তাঁরই মতো এক রানি। একা হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শত্রুদের বিরুদ্ধে। ভারতের সিংহাসনে বসা মহিলাদের মধ্যে একমাত্র এই একজনই এত দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছিলেন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রজাদের। ইতিহাস তো নিজের মতো সম্মান দিয়েছে রানি চেন্নাভাইরা দেবীকে। কিন্তু, আমরা সম্মান দিতে পেরেছি কি? নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের এই যুগে দাঁড়িয়ে, একবার কি আমরা স্মরণ করতে পারি না এই ইতিহাসকে? প্রেরণা নিতে পারি না?