‘ওই তো, রণেশকাকা আইসেন’ – তাঁর দিকে ইশারা করে দেখালেন শাহ নূরজালাল। সেই প্রথম দেখা সামনাসামনি। এবং, ওই একদিনই। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে আরেকটু কাছ থেকে জানতে হাজির হয়েছি উজানধলে। যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না। কলকাতা থেকে প্রথমে ঢাকা, সেখান থেকে সিলেট। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা। তারও প্রত্যন্তে উজানধল গ্রাম। শাহ আবদুল করিমের বসতভিটে। সেখানে তখন থাকেন তাঁর সন্তান, শাহ নূরজালাল। আমাদের অনুরোধে, ডাক গেল রণেশ ঠাকুরের কাছে।
শাহ আবদুল করিমের সাক্ষাৎ শিষ্য রণেশ ঠাকুর। শিষ্যত্ব অবশ্য সুরে-সুরে। গানের হাত ধরেই কবে জানি মুরিদ হয়েছিলেন বাউলের। তিনি ও তাঁর দাদা রুহী ঠাকুর। সেই শৈশব থেকেই আবদুল করিমের সঙ্গে-সঙ্গে। রুহী ঠাকুর দেহ রেখেছেন আগেই। আছেন রণেশ ঠাকুর।
আলাপ তো হল। হাসিমুখে এসে হাজির। নদীর পাড়ে বসে, মুর্শিদের গান শোনালেন একের পর এক। আমরা চমকিত। এমন সুর তো শুনিনি আগে! রণেশ ঠাকুর হাসলেন। এ-সুর তাঁর মুর্শিদের নিজস্ব। সৃষ্টির পবিত্রতা মিশে আছে। আমরা যা শুনি, তা শহরে গিয়ে, বহু হাতে ঘুরে-ঘুরে বিকৃত এক সুর। আসলটি শোনালেন রণেশ ঠাকুর। আমরা ধন্য হলাম। তাঁর গানে, কথায়। ‘আবার আসবেন ভাই।’
সেদিন রণেশ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাড়ি থেকে হারমোনিয়ামটা নিয়া আসব? নইলে সুর ধরব কী করে!’ বারণ করেছিলাম। খালি গলায় তাঁর গান ভেসে বেড়াচ্ছিল উজানধলের হাওয়াবাতাসে। কিন্তু সেই থেকেই রণেশ ঠাকুরের ‘হারমোনিয়াম’-এর প্রতি এক আশ্চর্য কৌতূহল আমার। না জানি কেমন জাদু আছে সেখানে!
গতকাল যখন খবরটা পেলাম, সবার আগে মনে পড়েছিল না-দেখা সেই হারমোনিয়ামের কথাই। সিলেট থেকে এক বন্ধু জানাল, কে বা কারা রণেশ ঠাকুরের বাসার গানের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। রোববার রাতের ঘটনা। ঘর তো পুড়েইছে, সেইসঙ্গে পুড়ে গেছে রণেশ ঠাকুরের ব্যবহৃত সব বাদ্যযন্ত্রও।
শুনে চমকে ওঠা এক, আর ছবিতে দেখা আরেক। ফেসবুকেই চোখে পড়ল একটা দৃশ্য। বাঁশের খুঁটিগুলো কোনোমতে দাঁড়িয়ে। পুড়ে কালো হয়ে গেছে টিনের দেওয়াল, ছাদ। আর সেই ভিটেয় দাঁড়িয়ে রণেশ ঠাকুর। ঝুঁকে ছুঁয়ে দেখছেন কিছু। কী দেখছেন তিনি? তাঁর সেই হারমোনিয়াম? জানি না।
এতদূর থেকে হয়তো আর জানতেও পারব না। যেমন জানা যায়নি কে তাঁর বাসায় আগুন লাগাল, সে-খবরও। আমি শুধু কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি তাঁর করুণ মুখ। সম্বল আর কতটুকু! দারিদ্র্যেই কাটে দিন। তার মধ্যেও এভাবে বাসা খোয়ানো! সহ্য হয়, ঠাকুর?
‘হারমোনিয়ামটা নিয়া আসি ভাই?’ মনে পড়ছে সে-কথাও। মনে পড়ার কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি এখনও…