বিংশ শতাব্দী শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর হল। আর তার মধ্যেই নেমে এল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এত বড়ো সমরায়োজন, এমন ধ্বংসলীলা এর আগে পৃথিবী দেখেনি। ব্রিটিশ কলোনি হওয়ার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিল। আর এরই অংশ হিসেবে তৈরি হল বাঙালি পল্টন। সেখানেই নাম লেখালেন এক বাঙালি যুবক। মাঝারি উচ্চতা, আর রোগাটে একটা চেহারা। এত রোগা ছেলে যুদ্ধে অংশ নেবে! ইংরেজরা তো অবাক। মুখ টিপে হেসেও নিল খানিক। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাসের চোয়াল শক্ত। শরীর নয়; নজর দাও মনে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে অসীম সাহস…
সিলেটের ছেলে তিনি। ছোটো থেকেই মাঠে-ঘাটে খেলে বড়ো হয়েছেন। আর সেই পরিবেশই তাঁর ভেতরে তৈরি করেছিল এক দৃঢ় মনোভাব। অবশ্য রামনাথ বিশ্বাসের কাহিনি কেবল বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নয়। অতি অল্প বয়সেই রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন তিনি। রাজনীতি বলতে, বিপ্লব। কিশোর রামনাথ দেখছেন ব্রিটিশদের অত্যাচার। দেখছেন বঙ্গভঙ্গ। তখন চারিদিকে বিপ্লবের হাওয়া। নরম নীতি নয়, লাঠির জবাব লাঠি দিয়েই দেওয়া হবে। সেই আঁচ এসে লাগল তাঁর শরীরেও। কিশোর রামনাথ যোগ দিলেন অনুশীলন সমিতিতে। অবশ্য এই কাজটি করার জন্য যে সামান্য একটা চাকরি পেয়েছিলেন, সেটিও চলে গেল।
পাঠক, এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, ব্রিটিশ বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন রামনাথ বিশ্বযুদ্ধে নাম লেখালেন? যুদ্ধ করলে তো সেই ব্রিটিশদের হয়েই লড়তে হবে। তাহলে? এখানেই চলে আসবে রামনাথের আরও একটি সত্তা— তাঁর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা। বাঙালিদের সম্পর্কে একটি বদনাম বরাবরই ছিল। তাঁরা নাকি একটু আয়েশে কাজ করতে ভালোবাসে। তখনকার দিনে পান চিবোতে চিবোতে আপিসে যেতেন বাবুরা। রামনাথ বিশ্বাসের মতো মানুষেরা এই ছাঁচে গড়া ছিলেন না। বাঁধাধরা চাকরি ছিল না-পসন্দ। তার চেয়ে অ্যাডভেঞ্চারই ছিল তাঁর কাছে আসল জিনিস…
এখান থেকেই সাগর পাড়ি দিলেন রামনাথ। মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধ করতে গেলেন বটে; কিন্তু শরীর কি শুরুতেই এত ধকল নিতে পারে? অসুস্থ হয়ে চলে এলেন বাড়ি। কিন্তু ঘরবন্দি হয়ে থাকার মানুষ তো তিনি নন। আবারও চলে গেলেন সৈন্যদলে। তবে এই যাওয়া অন্য এক দিগন্ত খুলে দিল তাঁর সামনে। কিশোর বয়সেই সাইকেল চালাতে শিখেছিলেন রামনাথ। সেই সাইকেলই ধীরে ধীরে নেশায় চেপে গেল। সেনাবাহিনীতে কাজের সুবাদে যখন সিঙ্গাপুরে এলেন, তখন সেই নেশা যেন আবারও পেয়ে বসল। ঠিক করলেন, সাইকেলে করেই বিশ্বভ্রমণ করবেন। অ্যাডভেঞ্চার!
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। ১৯৩১ সাল। সিঙ্গাপুর থেকে প্যাডেল চলা শুরু হল। রামনাথ বিশ্বাসকে দেখে সবাই হতবাক! সাইকেলে করে কী করে বিশ্বজয় করা যায়? রামনাথের মনে কিন্তু একফোঁটাও সংশয় ছিল না। দুটো চাদর, চটি, আর সাইকেল মেরামতির বাক্স— এই হচ্ছে সম্বল। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই তিনি ঘুরলেন। তবে এখানেই থেমে রইল না যাত্রা। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে আরও দুবার সাইকেল বের হয় রাস্তায়। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন হয়ে প্রায় গোটা ইউরোপ, এবং শেষমেশ আফ্রিকা আর আমেরিকা— রামনাথের কাছে হার মেনেছিল সমস্ত বাধা-বিপর্যয়।
রামনাথ যে কতখানি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ ছিলেন, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তখন তিনি আফ্রিকা ভ্রমণে ব্যস্ত। সেখানে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন দুজন স্থানীয় মানুষ। রামনাথ ততদিনে লক্ষ করেছেন আফ্রিকায় কালো মানুষদের দুর্দশা। মনে রাখা দরকার, তখনও আফ্রিকায়, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের রমরমা। শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা ভারতীয়দের যেমন অশ্রদ্ধা করতেন, ভারতীয়রাও তেমনি স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দেখলে নাক কুঁচকে থাকত। যাই হোক, এই তথাকথিত পিছনে পড়ে থাকা মানুষরাই রামনাথের সঙ্গী হয়েছিল। আফ্রিকার জঙ্গলে ঢুকে, সেখানকার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে যান তিনি। হঠাৎই খেয়াল হল, পকেটে কড়কড় করছে বেশ কিছু পাউন্ড। প্রকৃতির এমন বিশুদ্ধ আবহাওয়ায় নাই বা থাকল টাকা! অত লোভও তো তাঁর নেই। পকেট থেকে ওই টাকা বার করে সঙ্গী দুই আফ্রিকানদের বিলিয়ে দিলেন রামনাথ বিশ্বাস। ওঁরা অবশ্য এমন ঘটনা দেখে বাঙালিবাবুটিকে ‘পাগল’ই ভেবেছিলেন…
আরও পড়ুন
নিউটাউনে তৈরি হতে চলেছে রাজ্যের প্রথম সাইকেল ভেলোড্রোম, জানালেন হিডকো কর্তা
ওপরের গল্পটা লিখতে লিখতে বারবার মনে হচ্ছিল ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’-এর কথা। একটা ছেলে টাকা পয়সা জ্বালিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বোহেমিয়ান জীবনে। হ্যাঁ, পাগলই ছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। তাই নিজের শর্তে বেঁচেছেন প্রতিটা মুহূর্তে। নিজের যুক্তিতে, বুদ্ধিতে, আদর্শের চোখে দেখেছেন গোটা পৃথিবী। ম্যাপ বইয়ের পৃথিবী নয়; একেবারে বাস্তব জগত-সংসার। বহুবার বিপদে পড়েছেন, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, পা ভেঙেছেন; কিন্তু মনোবল হারাননি এতটুকুও। আফ্রিকার মানুষদের কথা তুলে ধরেছিলেন নিজের বইতে। ‘দেশ’ পত্রিকাতেও ভ্রমণকাহিনি লিখতেন রামনাথ। সেই লেখা পৌঁছে গিয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেও। আজকের পুঁজিসর্বস্ব পৃথিবীতে বোধহয় এমন বাউণ্ডুলে মানুষদেরই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।
তথ্যসূত্র-
১) ‘দুই চাকায় ঘুরেছেন সারা দুনিয়া’, আশরাফুজ্জামান, প্রথম আলো
২) ‘কে সভ্য, কে বর্বর বলে গেছেন রামনাথ বিশ্বাস’, স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor