১৮৭৪ সাল। রামকৃষ্ণের বয়স তখন ৩৮ বছর। একদিন যদুমল্লিকের বাগানবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছেন। বাবুয়ানি দিয়ে মোড়া বাগানবাড়ি। তাতে বিলেতি প্রভাব স্পষ্ট। রামকৃষ্ণদেব ঘুরে ঘুরে সব দেখতে দেখতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল দেয়ালে টাঙানো একটি তৈলচিত্রে। আর সেই ছবিটি ছিল শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে মা মেরির ছবি। রামকৃষ্ণদেব ‘যত মত তত পথ’-এর বাণী নিজের জীবন দিয়ে পালন করে গিয়েছেন। আর সেই জীবনে সেদিন যুক্ত হল আরও একটি মাত্রা। সেই দিনটির কথা মাথায় রেখেই আজও পৃথিবীর প্রতিটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে বড়োদিনের সন্ধ্যায় উৎসবে মেতে ওঠেন সন্ন্যাসীরা। ক্যারলের সুরে কেক কেটে উদযাপন হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন।
কলকাতার বড়োদিন মানেই মনে আসে পার্ক স্ট্রিট, সাহেবপাড়া আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার কথা। রামকৃষ্ণ মিশনের বড়োদিনের উৎসব কিন্তু নেহাত কম দিনের নয়। বরানগরে মঠ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই রীতি চলে আসছে। পরে বেলুড়, রহড়া এবং অন্যান্য মিশনেও সেই রীতি মেনে চলা হয়। শোনা যায়, রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পরেই একবার বরানগর মঠে বসে সতীর্থদের সঙ্গে গল্প করছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তখন অবশ্য তিনি বিবেকানন্দ হননি। স্বামীজির পরবর্তী নানা লেখাতেও তিনি উল্লেখ করেছেন, বেদান্ত দর্শনের বাইরে যে কয়েকজন মনীষীর কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন, তাঁদের একজন প্রভু যিশু। স্বামীজির সেদিনের সেই আবেগঘন বর্ণনা সতীর্থদের মন স্পর্শ করে গিয়েছিল। আর এই আলোচনার শেষেই সবাই খেয়াল করেন, দিনটি ২৪ ডিসেম্বর। অতএব সেই রাত্রেই সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন শুরু হল অনুষ্ঠানের আয়োজন। এভাবেই রামকৃষ্ণ মিশনে বড়োদিনের সূচনা।
যদু মল্লিকের বাড়ি থেকে ফিরেও নাকি রামকৃষ্ণদেবের ভাবসমাধি কাটেনি। তিনদিন তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরেও যাননি। একমনে একদিন পঞ্চবটী বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন এক গৌরকান্তি মূর্তি। সেই পুরুষ ক্রমশ ঠাকুরের দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু রামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতে গিয়েই দেখেন মূর্তি অদৃশ্য হয়েছে। এরপরেই তিনি জ্ঞান হারান। ভক্তরা অনেকেই মনে করেন, তাঁর শরীরেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন যিশুখ্রিস্ট।
অবশ্য রামকৃষ্ণের ধর্মজ্ঞান সত্যিই বিচিত্র। যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে তাঁর একটি রসিকতাও তেমনই অবাক করে। একদিন তিনি শিষ্যদের জিজ্ঞেস করলেন, যিশুখ্রিস্টকে কেমন দেখতে? সবাই একে একে বাইবেল মেনে বর্ণনা দিলেন। প্রত্যেকেই বললেন, গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, টিকালো নাক। সব শুনে রামকৃষ্ণ বললেন, “আমি কিন্তু বাপু স্পষ্ট দেখলাম তাঁর নাকের সামনে চ্যাপ্টা।”
শোনা যায়, দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের মধ্যেই যিশুপুজোর আয়োজন করেছিলেন রামকৃষ্ণদেব। পরবর্তীকালে সেই রীতিই মেনে আসছে রামকৃষ্ণ মিশন। আর এই করোনা পরিস্থিতিতেও তার প্রস্তুতি একই রকম। রাজ্যের প্রতিটা মিশনেই একইভাবে ক্যারলের সুরে, কেক কেটে উদযাপন করা হবে বড়োদিন। অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় দর্শকের সংখ্যার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু নিজের নিজের বাড়িতে যিশুপুজোর অনুষ্ঠানে মেতে উঠবেন সমস্ত ভক্ত।
তথ্যসূত্রঃ রামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম
আরও পড়ুন
উৎসবের মেজাজ ফিকে, ক্রিসমাসের আগের দিনেও বিষণ্ণ কলকাতার অ্যাংলো-পাড়া
Powered by Froala Editor