আলো নেই ওদের পৃথিবীতে। আছে শব্দ, স্পর্শ। তাই দিয়ে রোজ একটু একটু করে নিজেদের পৃথিবীটা গড়ে তোলে। আমরা যারা চোখে দেখতে পাই, তারা সেই পৃথিবীর নাগাল সহজে পাব না। কখনও অন্ধকার ঘরে চোখ বন্ধ করে চলাফেরা করতে গেলেই কেমন অসহায় লাগে। ওরা কিন্তু স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। না, আমাদের সহানুভূতির আতিশয্য প্রয়োজন নেই ওদের। প্রয়োজন একটু মানুষের মতো বাঁচার স্বীকৃতি। কথা হচ্ছিল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির প্রাক্তন ছাত্র সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে। সায়ন্তনদা বলছিলেন, "অন্ধ তো আমরা মনে। দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যের বেশিরভাগটাই সমাজ তৈরি করে দিয়েছে।" আবার এই সমাজের মধ্যেই কতো মানুষ দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে যাতে এই ব্যবধান সরিয়ে পাশাপাশি হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে পারি। সায়ন্তনদা নিয়ে গেলেন তেমনই এক স্বপ্নের পৃথিবীতে।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মূল ক্যাম্পাসের অদূরেই ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি। ১৯৫৭ সালে এই স্কুলটি তৈরি হয়। তারপর দীর্ঘ ৬৩ বছরের যাত্রাপথে ধীরে ধীরে নানা বিবর্তন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রতি বছর জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বার্ষিক উদযাপনী অনুষ্ঠানে ধরা থাকে তারই কিছুটা। এবারে ৬৩তম বার্ষিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে জানুয়ারির ২২ তারিখ। ক্যাম্পাস জুড়ে তাই সাজো সাজো রব। দোতলার বিভিন্ন ঘরে চলছে ছাত্রদের তৈরি নানারকম মডেলের প্রদর্শনী। আলাদা আলাদা ভাবে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এমনকি কারুশিল্পের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে ছাত্ররা। ওরা প্রত্যেকেই দৃষ্টিহীন। অথচ কী অদ্ভুত যত্ন আর নৈপুণ্য নিয়ে নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছে একেকটি মডেল।
অবাক হতে গিয়েও হই না। হয়তো আমার এই অবাক হওয়ার মধ্যেও মিশে থাকছে সমাজের একমুখী চলন। যেভাবে ওদের আলাদা করে রাখা হয়। "আহা, ওদের তো পারার কথা নয়। তবু পারছে।" এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভাঙতে চায় ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি। স্কুলের এক শিক্ষক, ইন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কথায়, "দৃষ্টিসম্পন্ন ছাত্রদের সাথে ওদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। শুধু ওদের পড়ানোর সময় বিশেষ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।" ইন্দ্রনাথবাবু নিজেও এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষাদানের পদ্ধতির কথা জিজ্ঞেস করতেই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন ইন্দ্রনাথবাবু। বোঝাতে থাকেন, কীভাবে বিভিন্ন মডেল, ব্রেইল, বিশেষভাবে তৈরি চার্ট, ম্যাপ এসবের সাহায্যে অডিও-ট্যাকটাইল পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। প্রথম থেকেই কি এই সমস্ত আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হত?
জানা গেল, ১৯৫৭ সালে ৯জন ছাত্র নিয়ে মিশনের একটি পৃথক কক্ষ থেকে যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন এসব কিছুই ছিল না। ধীরে ধীরে ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে পরিকাঠামো। নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন পদ্ধতি আয়ত্ত করেছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ২০০-র বেশি। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা পড়াশুনা করতে আসে। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। কৃষিকাজ ও পশুপালন বিষয়ে দুবছরের ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। বিদ্যালয়ের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টটি বর্তমানে আইটিআই কর্তৃক স্বীকৃত। প্রদর্শনীতে এইসব বিভাগের ছাত্ররাও সামিল হয়েছে। সায়ন্তনদা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন সব। কীভাবে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি সরঞ্জাম দিয়ে ছোট্ট একফালি মাঠের মধ্যে কৃষিকাজ শেখে ছাত্ররা, কীভাবে যন্ত্রের সাহায্যে কাগজের প্লেট বানাতে শেখে, সেইসব নমুনা নিয়েই প্রদর্শনী।
সায়ন্তনদা নিয়ে গেলেন কনসেপ্ট ডেভলপমেন্ট কক্ষে। যেখানে মাটির তৈরি মডেলের সাহায্যে তিনি ফলমূল পশুপাখি থেকে চিনতে শিখেছেন মানুষের বিবর্তনের নানা পর্যায় বা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া জীবজন্তুদের। দেখালেন আঞ্চলিক ব্রেইল প্রেস ও অডিও বুক রেকর্ডিং সেন্টার। বাংলা ইংরেজি সহ দশটি ভাষায় ব্রেইল বুক ও অডিও বুক তৈরি হয় এখানে। আর সবশেষে গেলাম 'আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট' প্রদর্শনীতে। দেখলাম পেন্সিলের পরিবর্তে উলের সাহায্যে কী অসাধারণ সব ছবি এঁকেছে প্রাথমিক স্তরের ছোট্ট ছোট্ট সব ছাত্ররা।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে সমাজ। নানা জায়গায় তাদের সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে কেবল পড়াশুনো নয়, একই সঙ্গে তাদের সারাদিনের জীবনযাত্রার একটা ছবি ফুটে উঠতে দেখলাম। অন্যান্য স্কুলে যেখানে দৃষ্টিসম্পন্ন ছাত্রদের সঙ্গেই পড়াশুনো করে দৃষ্টিহীন ছাত্ররা, তা থেকে এই স্কুলের পার্থক্যটা ঠিক কোথায়? প্রশ্ন করতে সায়ন্তনদা বলে, "সারাদিনের কাজকর্ম, চলাফেরা; এককথায় ডেইলি লাইফের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সেসব তো এখান থেকেই শিখেছি।" সায়ন্তনদা নিজেও এখান থেকে পাশ করে প্রথমে পাঠভবন ও পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন। বর্তমানে সরকারি দপ্তরে চাকরি করেন। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি, নিজেই সামলান তিনি। আর এসবের পিছনে ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির কথা যে না বললেই নয়।
সন্ধের পর শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমদিন সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশন। দ্বিতীয়দিন নাটকের অনুষ্ঠান আছে শুনলাম। দেখা হয়ে উঠল না। কিন্তু একদল দৃষ্টিহীন ছাত্র মঞ্চ দাপিয়ে নাটক করছে, ভাবতেই কেমন শিহরণ জাগে।