রামরাজত্ব থেকে নির্দোষ রামপত্নীর নির্বাসন—বাল্মীকি রামায়ণে উত্তরকাণ্ডের এই কাহিনি চিরকাল পাঠকদের তীব্র বিষাদের মুখোমুখি করেছে। যেমন মধ্যযুগে, তেমনি আধুনিক যুগেও বহু প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক উত্তরকাণ্ডের কাহিনিকে নিজেদের মনের মতো করে ভেঙেছেন, গড়েছেন। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে, এ তালিকায় আছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে নবনীতা দেবসেন, অনেক লেখক-লেখিকা। অন্য ভাষার কবিরাও থেমে নেই। রামানন্দী সম্প্রদায়ের বর্তমান আচার্যদের অন্যতম রামভদ্রাচার্য রচনা করেছেন 'গীতরামায়ণম্'। এ-কাব্যে অযোধ্যার রাজদম্পতি সীতারামের দাম্পত্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, কোনো দোষারোপ নেই, বিষাদ নেই, আছে অনিঃশেষ আনন্দের উচ্ছ্বাস। এ এক বিকল্প উত্তরকাণ্ড।
রামভদ্রাচার্য অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ—ভগবদ্গীতা, ভক্তমাল, ব্রহ্মসূত্র, বিভিন্ন উপনিষদ প্রভৃতি। প্রণয়ন করেছেন রামানন্দী পরম্পরার দর্শন অনুসারে বিবিধ শাস্ত্রের ভাষ্য। স্বয়ং অন্ধ, তাই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি চিত্রকূটে স্থাপন করেছেন বিকলাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এই সমস্ত কীর্তির পাশাপাশি, তিনি একজন কবিও বটে। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কাব্যের অনুপ্রেরণায় রামচন্দ্রকে নিয়ে তিনি রচনা করেছেন 'গীতরামায়ণম্' কাব্য। এই কাব্যের উত্তরকাণ্ডের দ্বিতীয় সর্গ নিয়েই আমাদের আলোচনা।
এই বিকল্প উত্তরকাণ্ডের আত্মপ্রকাশ কি নেহাতই আকস্মিক একটি ঘটনা? এ কি কবির ব্যক্তিগত পরিকল্পনা? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর, না৷ কয়েক শতাব্দী আগে কবি তুলসীদাস যখন 'শ্রীরামচরিতমানস' রচনা করেছেন, তখনই তিনি উত্তরকাণ্ডকে উপস্থাপন করেছেন নতুন ভঙ্গিতে। তাঁর উত্তরকাণ্ডে সীতা ‘সন্ততমনিন্দিতা’... সর্বত্র অনিন্দিতা, তাঁর চরিত্র নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না, কোনও দোষারোপ করে না। তাঁর নির্বাসনে যাওয়া, কিংবা পাতাল প্রবেশের কাহিনি তুলসীদাসের মহাকাব্যে সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়েছে। সুবোধিনী টীকা সহ শ্রীরামচরিতমানস সম্পাদনা করার সময় রামভদ্রাচার্য এইদিকে ইঙ্গিত করেছেন, এবং নিজের আরেকটি বই 'সীতা নির্বাসন নঁহী'-তে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ দেখিয়েছেন—বাল্মীকির নামে প্রচলিত উত্তরকাণ্ড আসলে প্রক্ষিপ্ত। আর, গীতরামায়ণম্ কাব্যে তিনি যে নব্য উত্তরকাণ্ড রচনা করেছেন তা যে কেবল তাঁর নিজস্ব কল্পনা নয়, অযোধ্যা অঞ্চলের বহুদিনের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতির অনুপ্রেরণা-সঞ্জাত, তাও তিনি নিজের কাব্যে উল্লেখ করেছেন। সেইসঙ্গে, যথাসম্ভব উদ্ধৃত করেছেন সেইসব লোকগীতি, সাধারণ জনতার মুখে মুখে ফেরা বিকল্প রাম-কথা-গান।
গীতরামায়ণম্ কাব্য অনুসারে, বহুবর্ষ রাজকর্তব্য পালন ও রাজসুখভোগের পর, রাজদম্পতির মনে রঘুবংশ বৃদ্ধির ইচ্ছা হল। তখন রাম সীতাকে বললেন—"সীতে দ্বৌ তনয়ৌ মে দেহি। অযোনিজাপি ধর্মরক্ষার্থং গর্ভে মামাধেহি।।" অর্থাৎ—সীতা, আমাকে দুটি পুত্র দাও। তুমি অযোনিজা, তাও ধর্মরক্ষার্থে আমাকে গর্ভে ধারণ কর। রাম বলছেন—তাঁর দুই প্রতিবিম্ব সীতার জঠরে ক্রীড়া করবে, তিনি নিজেকে দ্বিধা করে দুই পুত্রের জন্ম দেবেন, স্বয়ং লব ও কুশ রূপে প্রকট হয়ে ত্রিলোককে আনন্দিত করবেন। রামের এই সংলাপের মধ্যে কত শতাব্দীর দার্শনিক গভীরতা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। "আত্মা বৈ জায়তে পুত্রঃ"— এই তাত্ত্বিক উচ্চারণই রূপ পেয়েছে এই কাহিনিতে।
সীতা পুত্রবতী হলেন আষাঢ় মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। অযোধ্যায় আনন্দের বান ডাকল। রাজপরিবার মেতে উঠল উৎসবে। একে একে পালিত হল দুই পুত্রের জন্মপরবর্তী ষষ্ঠী, দ্বাদশী আদি অনুষ্ঠান। গুরু বশিষ্ঠ দুই শিশুর নামকরণ করলেন।
এই আনন্দের হাটে কবি আনলেন আরেকটি চরিত্রকে। তিনি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা চলে, চিরকালই ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’। তিনি শান্তা, দশরথের প্রথম সন্তান, যাঁকে অনায়াসে বন্ধুর হাতে পোষ্যপুত্রী হবার জন্য তুলে দিয়েছিলেন রাজা। তিনি ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী, রাজ্ঞী হবার সুখ থেকে চিরবঞ্চিতা। সেই তাপসবধূ শান্তা এলেন, বনবাসের সমস্ত গ্লানি ভুলে গেলেন পিসিমা হবার আনন্দে। উচ্ছ্বসিত শান্তা একবার রামের কাছে, একবার সীতার কাছে আবদার করতে লাগলেন উপহারের জন্য। সীতা নিজের হাত থেকে কঙ্কণ খুলে দিয়ে প্রসন্ন করলেন ননদিনীকে।
লব কুশ আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগলেন। তিন ঠাকুমার হাত ধরে টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখলেন। একটু বড়ো হতে পিতা রাম তাঁদের চেনাতে আরম্ভ করলেন বর্ণমালা, মা সীতা শেখাতে আরম্ভ করলেন অ আ ক খ-র উচ্চারণ। দুই ছেলেকে নিয়ে খুশিতে ভরে উঠল রাজদম্পতির সংসার।
পরিবার-পরিজন সহ শিশুদের কলহাস্যের মধ্যে ভরা রাজসংসারে সীতারামকে রেখে, কাব্য সমাপ্ত করেছেন রামভদ্রাচার্য।
Powered by Froala Editor