বয়স ৯৬ বছর। চামড়া কুঁচকে গেছে, জোরও কমে গেছে অনেক। কিন্তু তাতে কি! এখনও তো মরে যাননি! বেঁচে তো আছেন দিব্যি। তাহলে কেন কাজ করবেন না? তাই কদিন আগেও নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন রমা মেহতা খান্ডওয়ালা। ভারতের প্রবীণতম টুরিস্ট গাইড। এইটুকু অধ্যায়ও অনেককে সান্ত্বনা দেবে, মনে বল দেবে। ‘এইটুকু’ বলা হল, কারণ রমা মেহতার আসল কাহিনিগুলো বলতে গেলে এখানে থেমে গেলে অত্যন্ত অন্যায় হবে। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নারী নিজেই ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ। তাঁর সঙ্গে যে জুড়ে আছে আরও দুটো নাম— আজাদ হিন্দ ফৌজ, এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!
রমা মেহতার জীবন কোনো কাহিনির থেকে কম নয়। নানা পথ ঘুরে, ঝড় সহ্য করে আজ তিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বমহিমায়। দেশের প্রবীণতম টুরিস্ট গাইডই শুধু নন, তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর জীবিত প্রবীণতম সদস্যাও। একটা সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন জাপানে। লক্ষ্য স্বাধীনতার যুদ্ধ। হাতে উঠল বন্দুক। কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। আর আশীর্বাদ করলেন স্বয়ং নেতাজি! আজও সেই দিনগুলোর কথা মনে করলে রোমাঞ্চ তো হয়ই।
জন্ম ১৯২৬ সালে বার্মায়, মানে আজকের মায়ানমারে। যখন স্কুলের ছাত্রী, পড়াশোনাই ধ্যানজ্ঞান, তখনই শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। চল্লিশের দশক সেটা। এদিকে ভারতেও সমানভাবে চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। এরই মধ্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ঘটে গেল অভাবনীয় একটি ঘটনা। সুভাষচন্দ্র বসু উপস্থিত হলেন জাপানে। তৈরি করলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী। এশিয়ার অনেক দেশই সাদরে বরণ করে নিল পুরো ফৌজকে। ভারতে ব্রিটিশদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। আর এই ধাক্কাই নাড়িয়ে দিয়েছিল রমাকেও। শুধু রমাই নন, গোটা মেহতা পরিবার যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন। নেতাজির স্বাধীনতার বাণী, লড়াইয়ের ডাক গ্রহণ করলেন তাঁরা। রমা মেহতা তো বটেই; তাঁর বোন নিলম মেহতা ও মা লীলাবতী মেহতাও যোগ দিলেন সেই ডাকে। এদিকে লীলাবতীদেবী উন্নীত হলেন মেজর পদে। তারপর দুই মেয়েও যোগ দিলেন ঝাঁসির রানি বাহিনীতে। যে হাতে পেনসিল-পেন ছিল, সেখানেই উঠল বন্দুক-কার্তুজ।
এরকম পুরো পরিবারের একসঙ্গে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার নিদর্শন আছে কি আর? গবেষণা চলতেই পারে। তবে শুধু বন্দুক চালানোই নয়, যুদ্ধ পরিচালনা করা, নেতৃত্ব দেওয়া ও নার্সিংয়ের কাজও শিখেছিলেন রমা। আস্তে আস্তে নিজের দক্ষতার জোরেই এগোতে থাকেন তিনি। সাধারণ সিপাই থেকে লেফটেন্যান্ট, কমান্ডার ও শেষে গার্ড অফ অনার সম্মান। আর তখনই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ। সেই দিনের কথা আজও ভুলতে পারেন না রমা মেহতা!
একবার রমা মেহতা রাতের বেলা ক্যাম্প গার্ড দিচ্ছিলেন। হঠাৎই বেকায়দায় একটি গর্তে পড়ে যান। পা মারাত্মকভাবে জখম হয়। বেশ কিছুদিন হাসপাতালেই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। তখন বেশ কয়েকবার রমা’র খোঁজ নিতে এসেছিলেন নেতাজি। তাঁকে কাঁদতে দেখে নেতাজির বক্তব্য ছিল, কান্না নয়। স্বাধীনতার যুদ্ধে নামার আগে এই কান্না তো দুর্বল করে দেবে। এই সামান্য আঘাতেই কাঁদবে! ব্যস, এই কটা কথাই বদলে দেয় তাঁকে। আর কাঁদেননি তিনি। তবে ১৯৪৪ সালে একবার একটা এয়ার রেইডের সময় বিপদে পড়েছিলেন তিনি। প্রায় মারাই যাচ্ছিলেন। কিন্তু, ‘রাখে হরি মারে কে’…
আজাদ হিন্দ ফৌজের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল সবাই জানেন। নেতাজির কী হয়েছিল, আজও কেউ জানেন না। এইরকম পরিস্থিতি থেকেই একসময় বেরিয়ে আসেন তিনি। রাজনীতির নানা খেলা চলতে থাকে। স্বাধীনতার পর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল স্বয়ং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেই সঙ্গে নিয়ে আসেন কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আহ্বান। কিন্তু রাজনীতির ময়দান থেকে শতহস্ত দূরে থাকবেন বলে ঠিকই করে রেখেছিলেন রমা মেহতা। জাপানি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন মায়ানমারে থাকতেই। নার্সিংয়ের চাকরি, সেক্রেটারির কাজ পেরিয়ে অবশেষে পর্যটনকেই বেছে নেন। টুরিস্ট গার্ডের প্রশিক্ষণ নেন, পরে সেটাই হয় তাঁর জীবিকা। এছাড়াও, জাপানি টিভি ডকুমেন্টারির অনুবাদকের কাজও করেন।
তবে সবথেকে বেশি তিনি পরিচিত টুরিস্ট গার্ড হিসেবেই। ঐতিহাসিক জায়গাগুলো পরিদর্শন করানোর পাশাপাশি নিজের জীবনের গল্পও বলেন। তিনি নিজেও যে তারই শরিক! দুইয়ে মিলে ভরে ওঠে সবটা। আস্তে আস্তে অন্যতম পরিচিত মুখ ওই উঠলেন এই জগতের। নিজের একটা জায়গা তৈরি হল। ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যটন দিবসে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ‘সেরা টুরিস্ট গাইড’-এর শিরোপাও পান। ততদিনে তিনি নব্বই পেরিয়ে গেছেন। ২০১৯-এ এসে হয়েছেন টেড-এক্স টকার।
৯২ বছর বয়সে এসে, শারীরিক কারণেই বন্ধ রেখেছেন কাজ। এতগুলো বছর, নিষ্ঠা দিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। সে যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, বা পর্যটন ক্ষেত্রে। রমা মেহতা বা ‘রমা বেন’ যে সেলেব্রিটি! নিজেই ইতিহাস! আজও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন তিনি। সত্যিই, ইতিহাস কত আশ্চর্যের!