পাশাখেলায় হার। যৌতুক রেখেছিলেন, তাই স্ত্রী দ্রৌপদীকে তুলে দিতে হয়েছিল বিপক্ষের হাতে। সেই হেতু বস্ত্রহরণ ও সভ্যতার লজ্জা। এহেন কাজের জন্য আজও প্রবলভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। কিন্তু আরও একজন ‘আদর্শ পুরুষ’, যাঁর নামের সঙ্গে ধর্মরাজ্য সমার্থক, তিনিও কি পত্নীকে যৌতুক হিসেবেই গণ্য করেছিলেন! তাই অন্যের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন পত্নীকে। হ্যাঁ, বাল্মীকি রামায়ণ অন্তত তাই-ই বলে। জানায়, সীতাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র।
আরও পড়ুন
কেন নারীলোলুপ নন কৃষ্ণ? জানিয়েছিলেন ইসমত চুগতাই
কী সেই ঘটনা? জনকরাজার কন্যা সীতাদেবীর সঙ্গে রামের যখন বিবাহ হল, তখন তিনি যৌতুক হিসেবে নানা সামগ্রী, দাসদাসী ও একশো কন্যাও পেয়েছিলেন। রাম ফিরতেই দশরথ তোড়জোড় শুরু করলেন তাঁর অভিষেকের। এত তাড়া যে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করতেও ভুলে গেলেন। বা বলা ভালো, ইচ্ছে করেই ভুলে রইলেন। কারণ কেকয়রাজার কন্যার কাছে অর্থাৎ তাঁর আদরের স্ত্রী কৈকেয়ীর কাছে তিনি কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা তিনি খুব ভালোই জানেন। তাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব রামের অভিষেকটা সেরে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু কৈকেয়ী তো ছাড়বার পাত্রী নন। তিনি রামের বনবাস ও ভরতের জন্য রাজ্য চেয়েই বসলেন। একেবারে মোক্ষম সময়ে। এই ঘটনার জেরে আর যা যা হওয়ার তা তো হলই। রাম যখন শুনলেন, তখন মৃদু অভিযোগের স্বরে বললেন, এ কথা রাজা নিজেই তাঁকে কেন জানালেন না? জানালে রাজ্য তো বটেই, ভরতের জন্য রাজ্য, সীতা এমনকি প্রাণও দিয়ে দিতে পারতেন। সীতাকেও! এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা’ গ্রন্থখানিতে সিদ্ধান্ত টেনেছেন ‘লক্ষণীয়, যৌতুকে পাওয়া শত কন্যার মতো বিবাহিত ভার্যা সীতাকেও দানের কথা ওঠে; যেন তিনি ব্যক্তি নন, বস্তুমাত্রই; সমাজ নারীকে মুখ্যত এই দৃষ্টিতেই দেখত।’ রামায়ণের কাহিনি এবার অন্য খাতে এগোয়, নয়তো দ্রৌপদীর পরিণতি হয়তো হতে পারত সীতারও।
কিন্তু মনের এই দুঃখে আমার অন্তর্দাহ হইতেছে যে, মহারাজ স্বয়ং কেন ভরতের অভিষেকের কথা উল্লেখ করিলেন না! দেবি! রাজাজ্ঞার অপেক্ষা কি, আপনার অনুমতি পাইলে ভ্রাতা ভরতকে নিজেই রাজ্যধনপ্রাণ ও প্রফুল্লমনে সীতা পর্যন্ত প্রদান করিয়া প্রতিজ্ঞা পালন ও আপনার হিতসাধন করিব।
বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, একোনবিংশ সর্গ (গদ্যানুবাদ - হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)
অবশ্য এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের মানে এই নয় যে, রামের চরিত্রের সমালোচনা করা বা তার চরিত্রের বিশেষ কতকগুলো দিককে আলাদা করে চিহ্নিত করে একটা আখ্যান গড়ে তোলা। আমরা বরং দেখব, এই রামচন্দ্রই তাড়কা-কে বধ করতে ইতস্তত বোধ করছেন। কারণ স্ত্রী-বধে অন্যায় হবে। পরে বিশ্বামিত্রের প্রবোধে সে-কাজ তিনি করেন। আবার রামচন্দ্রই যে অহল্যার শাপমুক্তি ঘটান তা-ও আমাদের জানা। সীতাকে হারানোর পর রামের বিলাপও আমাদের অজানা নয়। অথচ, যুদ্ধ শেষে সেই সীতাকে ফিরে পাওয়ার পরই তিনি জানিয়েছিলেন, সীতাকে ফিরে পাবার থেকেও তাঁর কাছে বড় ছিল, তাঁর বংশের মর্যাদা রক্ষা করা। এবং আরও একবার তিনি সীতাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। অনুমতি দিয়েছিলেন, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, এমনকী বিভীষণ, সুগ্রীব যাকে ইচ্ছে তিনি যেন পতি হিসেবে বরণ করে নেন। পরে দেবতারা যখন সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করছেন, তখন রাম বলেন, এ তিনি আগেই জানতেন। শুধু সকলের প্রত্যয়ের জন্যই ছিল অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন। রাম খুব স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে, অপবাদের ভয়ে তিনি সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন। প্রাণ, ভাই-আত্মীয় এমনকী স্ত্রী অর্থাৎ, সীতাকেও। রামচরিত্রের এই জটিলতা বা বৈচিত্র আসলে একটা জটিল সমাজব্যবস্থারই দ্যোতক। রাম যা করেছেন তা একটা নির্দিষ্ট ব্যবস্থার অনুবর্তক হয়েই করেছেন।
সীতাকে ফিরে পাবার থেকেও তাঁর কাছে বড় ছিল, তাঁর বংশের মর্যাদা রক্ষা করা।
আজও যখন সেই রামকে সামনে নিয়েই ধর্মরাজ্যের নানা স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তখন মনে রাখতে হবে সেই সমাজ বাস্তবতার কথাটিও। তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে সে-খেয়াল আমাদের রাখতে হবে। কারণ, ‘আদর্শ পুরুষ’ আসলে একটা স্থির কাঠামো। তাকে হুবহু অনুকরণ করতে গেলে বিপদ বাড়বে। বরং রাম চরিত্রের এই বৈপরীত্যের সমাহার বিশ্লেষণ করলেই আমরা প্রকৃত বাস্তবতার সন্ধান পাব। রামের ভজনা নিশ্চিত সঙ্গত, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বাল্মীকির রাম দোষে-গুণে সমন্বিত। তিনি একটা নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আদর্শ প্রতিনিধি। কথা হল, সেই ব্যবস্থাটিকেই আজও আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই? আমরা কি সীতাকে আজও দ্রৌপদীর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চাই! এই বিবেচনাটিই আজ প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
(ছবি - রাজা রবি বর্মা)