হাওড়া থেকে রিষড়া— রামনবমীকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি জায়গায় জায়গায় ধর্মীয় হিংসার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বাংলা। এই হানাহানি, হিংস্রতার প্রতিবাদে রবীন্দ্রসদন চত্বরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির পাদদেশে এক বিশেষ সভার ডাক দিয়েছিলেন কবীর সুমন (Kabir Suman)। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান মানুষদের এক মঞ্চে হাজির করে বার্তা দিয়েছিলেন সম্প্রীতির। সম্প্রতি জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা দিবসে, নিজের বাড়িতে আয়োজিত ইফতারে আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন, এ-দেশ কারোর একার নয়, বাংলার সংস্কৃতির অংশ নয় বিচ্ছিন্নতাবাদ।
এদিন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ অংশ নিয়েছিলেন সেই ইফতারে। হাজির ছিলেন গ্রেস চার্চের ফাদার সঞ্জীব দাস, এসএসকেএম-সংলগ্ন সন্ত কুটিয়া গুরুদ্বারের তারশিম সিং, বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের পরমানন্দ গিরি মহারাজ, মহাবোধি সোসাইটির অরুণজ্যোতি ভিক্ষু, সদ্ভাবনা মঞ্চের শেখ তাহেরুদ্দিন, সাবির আলি, সুজাউদ্দিন, কবি প্রসূন ভৌমিক, অরূপশঙ্কর মৈত্র প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের উপস্থিতিতেই, সর্বধর্মের এই মিলন উৎসবে যাত্রা শুরু হল ‘রাম-মহম্মদ-সিং-আজাদ মঞ্চ’-এর (Ram-Mahammed-Singh-Azad Manch)।
কবীর সুমনের কথায়, এই ইফতার আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য একটি সম্মিলিত কণ্ঠ গড়ে তোলা। রামনবমীকে ঘিরে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় যে হিংসা ঘটেছে, তার পিছনে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা রয়েছে একদল মানুষের। ফলে এমন একটি মঞ্চ গঠনের প্রয়োজন রয়েছে, যেখানে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি করবে না। একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কবি প্রসূন ভৌমিকের কণ্ঠেও, “প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত থাকলেও, ধর্ম ও রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা দেখলে সরব হতে হবে আমাদের। প্রয়োজনে বসে পড়তে হবে ঘটনাস্থলে। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়।” এই উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম ‘রাম-মহম্মদ-সিং-আজাদ মঞ্চ’-এর।
হ্যাঁ, এই নামটিই উল্কি করে নিজের হাতে এঁকেছিলেন বিপ্লবী উধম সিং। কবীর সুমনের কথায়, ‘এটাই আমার ভারতবর্ষ। এমন দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।’ বহু বছর ধরে বয়ে চলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসকেই যেন শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে ভারতীয়দের বুক থেকে।
শুধু উধম সিং-ই নন, সুমন মনে করিয়ে দেন শ্রীচৈতন্যদেবের কথাও। যে বৈষ্ণবঘাটা লেনে কবীর সুমনের বাড়ি, যে-অঞ্চলে এই নতুন মঞ্চের প্রতিষ্ঠা, সেই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে চৈতন্যদেব। নীলাচল যাত্রার সময় এই অঞ্চলেই তাঁর শিষ্যদের নামিয়ে গিয়েছিলেন চৈতন্য। সে-সময় চৈতন্য-পার্ষদদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এই অঞ্চলের অগণিত দরিদ্র মুসলমান মানুষ এবং তথাকথিত হিন্দু 'অন্ত্যজ' শ্রেণির মানুষ, যাঁরা কেউ পুজো করতেন ওলাবিবির, কেউ বনবিবির। “বাংলার চরিত্র আদতে এটাই। এখানে কোনো ধর্মের চোখরাঙানি চলবে না”, বলছিলেন সুমন।
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সুমনের এই ডাকে ইতিমধ্যেই সাড়া দিয়েছেন বহু মানুষ। আগামীতে মঞ্চের কাজ বাড়লে, আরও বহু মানুষ অংশ হয়ে উঠবেন এই মঞ্চের, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সবমিলিয়ে কবীর সুমনের এই উদ্যোগ যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শঙ্খ ঘোষের সেই অমোঘ পঙক্তিটির কথাই, ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’।
Powered by Froala Editor