“একটানা বৃষ্টিতে দ্রুত বৃদ্ধি হয় ঘাসের। যা এতটাই লম্বা হয়ে যায় যে আমাদের দৃষ্টির পরিধিকে আটকে ফেলে ছোট্ট সীমার মধ্যে।” এমনটাই বলেছিলেন বাবা লাল দাস। ভেবেছিলেন, উত্তপ্ত হতে থাকা দেশের পরিস্থিতি থিতিয়ে আসবে এক সময়। চেয়েছিলেন, হিংসা থেকে সরে আসবে মানুষ। কিন্তু তেমনটা আর হল কই? ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের বুক থেকে মুছে গেল প্রায় পাঁচ শতক আগে তৈরি একটি স্থাপত্য। বাবরি মসজিদ।
বাবা লাল দাস। নামটা একেবারে অপরিচিত ঠেকাটাই স্বাভাবিক। সংবাদ মাধ্যমে সেই সময় থেকেই খুবইস্বল্পচর্চিত একটি নাম বাবা লাল দাস। ১৯৮১ সাল থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে অবধি অযোধ্যার রাম মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন তিনিই। তবে মসজিদ ধ্বংসের এক বছরের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। ১৯৯৩ সালের ১৬ নভেম্বর খুন হয়েছিলেন এই উদারপন্থী পুরোহিত। কিন্তু কেন মরতে হয়েছিল তাঁকে?
এই বিতর্কের শুরু আরেকটু আগে থেকে। তখনও ব্রিটিশ শাসন ভারতে। বেজে গেছে দেশভাগের ঘণ্টা। ঠিক সেই সময়েই ব্রিটিশ সরকাদের দৌলতেই ছড়িয়ে পড়ে একটি তথ্য। মুঘল সম্রাট বাবর রামমন্দিরের ধ্বংস করে সেই স্থানে গড়ে তুলেছিলেন বাবরি মসজিদ। সাম্প্রদায়িক বিভেদের আরও একটা সাজানো চাল ছিল ব্রিটিশরাজের। তখনও অযোধ্যার পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। বাবরি মসজিদের অবস্থান নিয়ে সেইভাবে কোনো বিতর্কের সূত্রপাতই হয়নি অযোধ্যায়। ১৮৮৫ সালে অযোধ্যারই এক পুরোহিত দাবি তুলেছিলেন রামের জন্মভূমি হল বাবরি মসজিদেরই বাইরের একটি চত্বরে। তবে সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছিল আদালত। তারপর থেকে রামের জন্মভূমি হিসাবে দাবি জানিয়েছে অযোধ্যার একাধিক মন্দির। কিন্তু কখনোই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি তা নিয়ে।
স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা হল একটি রামমূর্তি। প্রতিষ্ঠা করলেন মহন্ত রামসেবক দাস শাস্ত্রী। স্বয়ং রাম এসে তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন বলেই দাবি করেন তিনি। কার্যত সেই ঘটনাই উসকে দেয় বিতর্কের আগুন। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে.কে. নাইয়ার সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংঘর্ষের সম্ভাবনা এড়াতেই, নিষেধাজ্ঞা জারি করেন মূর্তি সরাতে। ধীরে ধীরে সেখানেই শুরু হয় পুজো। মসজিদের ইমামকে প্রশাসনিক স্তরে অনুরোধ জানানো হয়, নামাজ পড়ার কাজ মসজিদের অন্দরমহলেই সম্পন্ন করার জন্য।
তবে সেই বিতর্ক আরও জোরালো হয় কয়েক দশক পর মসজিদ প্রাঙ্গণে মন্দির প্রতিষ্ঠায়। আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল সেই জল। এই অস্থিরতার মধ্যস্থতা করে আদালত। শান্তি বজায় রাখতে ১৯৮১ সালে রামমন্দিরের পুরোহিত হিসাবে ঠিক করে দেওয়া বাবা লাল দাসের নাম। পুরোহিত লাল দাসের কাছে শেষ কথাই ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সমঝোতার মধ্য দিয়েই সমস্যা সমাধানের বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। চাইতেন হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষরাই পৃথক পৃথকভাবে সহাবস্থানের মাধ্যমেই প্রার্থনা করুক নিজেদের উপাস্যের।
লাল দাসের পুরোহিত হিসাবে নিয়োগের বছর দুয়েকের মধ্যেই ১৯৮৪ সালে সারা ভারত জুড়ে শুরু হয় ‘রাম জন্মভূমি ক্যাম্পেন’। ততদিনে দাবি উঠেছে, বাবরি মসজিদের প্রধান গম্বুজের ঠিক নিচের জমিই রামজির জন্মস্থান। আস্তে আস্তে তখন আরো জটিলতার দিকে এগোচ্ছে দেশের পরিস্থিতি। বাবরি মসজিদের সেই স্থানেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের সোমনাথ থেকে শুরু হয় ‘রাম রথযাত্রা’-র।
এই লেখার শুরু হয়েছিল যে উক্তি দিয়ে, সেটা এই সময়েরই। দিনটা ছিল ১৯৯০ সালের, ৩০ অক্টোবর। ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রের শুটিংয়েই বাবা লাল দাস এই মন্তব্য করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট দাবি করেছিলেন, রাজনৈতিক অভিসন্ধির কারণেই বিঘ্নিত করা হচ্ছে দেশের সম্প্রীতিকে। এমনকি রাম রথযাত্রা বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে ১৭ অক্টোবরের টাইমস অফ ইন্ডিয়ার দৈনিক পত্রিকায়।
১৯৯১ সালের জুনে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে নতুন সরকার। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রথম কাঁটা পেরিয়ে যায় তাতে। তবে এরপরেও আরেকটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরোহিত লাল দাসের উপস্থিতি। পরের বছর ১৯৯২ সালে সেই কাজটাই সেরে ফেলে সরকার। মার্চ মাসে রামমন্দিরের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সেই জায়গায় নিযুক্ত করা হয় মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসকে। বর্তমানেও যিনি রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। লাল দাসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয় ‘দুর্নীতি’-র অভিযোগ। তবে এই বিষয়ে বিশদে কোনো তথ্যই প্রকাশিত হয়নি সেই সময়ে। মুখ খোলেনি রাম মন্দিরের পরিচালক কমিটিও।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরেই ঘটে যায় ঐতিহাসিক সেই ঘটনা। গুঁড়িয়ে ফেলা হয় শতাব্দীপ্রাচীন বাবরি মসজিদকে। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে সব মিলিয়ে সারা দেশে মারা যান প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। অযোধ্যার ২০ কিলোমিটার দূরে ‘রাণীপুর চত্তর’ গ্রামে তখনও ঐক্যের সুতোয় হিন্দু-মুসলমানকে বেঁধে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন লাল দাস। মসজিদ ধ্বংসের দশ মাস পর ১৯৯৩ অক্টোবরে সাম্প্রদায়িক হিংসার মামলা দায়ের করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। ততদিনে প্রকাশ্যে এসে গেছে ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রটি। ঠিক তার পরের মাসেই ১৬ তারিখে গুলি করে খুন করা হয় বাবা লাল দাসকে।
তদন্তের আগেই কি প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবাদী চরিত্রকে সরিয়ে দেওয়া? তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর হত্যা রহস্যের মামলা বাঁধা পড়েছে লাল ফিতেয়। জায়গা-জমি নিয়ে বিবাদের কারণেই হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। এমনটাই দাবি জানিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু তাঁর হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কাজ শেষ করেনি পুলিশ। আজও।
জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বাবা লাল দাসের বিতর্কের ঘটনাটি সত্যি ছিল। কিন্তু তারিখের হিসাবে তা মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর ২৬ বছর পেরিয়ে গিয়ে সেই মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি এখনও।
বছর খানেক আগের দ্য ওয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাবা লাল দাসের প্রত্যক্ষদর্শীদের বেশ কিছু মন্তব্য পাওয়া যায়। যাঁরা জীবিত রয়েছেন এখনও। অযোধ্যার হনুমানগরী মন্দিরের এমনই একজন পুরোহিত জ্ঞান দাসের কথায়, ‘আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ সাধু’ ছিলেন লাল দাস। আদ্যপ্রান্ত একজন ভালো মানুষকে শত্রুদের হাতে খুন হতে হয়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করাতেই। এমনটাই উল্লেখ করেন তিনি। তবে এর বেশি কিছু প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন জ্ঞান দাস। নিজের নিরাপত্তার কারণেই।
বাবা লাল দাসের মৃত্যুর পর পার হতে চলল ২৭ বছর। কিন্তু সত্যিই কি এগিয়েছে দেশের পরিস্থিতি? ১৯৯২ সালের সেই দাঙ্গার রেশ কি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে ভারত? এমন আবহেই যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন বাবা লাল দাস। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া সেই পুরোহিতই। দেশের ঐক্য এবং সম্প্রীতির বাতাবরণ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে তাঁর মতোই ব্যতিক্রমী, প্রতিবাদী চরিত্রই যেন আবশ্যিক হয়ে পড়েছে বর্তমান সময়ে...
তথ্যসূত্রঃ
১. Ayodhya’s Forgotten Mahant and His Message of Peace – Valay Singh – The Wire
২. Ram Ke Naam – Ananda Patwardhan (তথ্যচিত্র)
৩. Two Real Sadhus of Ayodhya: Ram Das and Gyan Das – sabrangindia.in
Powered by Froala Editor