বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট। স্কোরবোর্ডে জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশের স্কোর ৯৫ রানে ১ উইকেট। ম্যাচের গতিপ্রকৃতি অনেকটাই যেন বলে দিচ্ছিল, প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ২৫৭ রানের লক্ষ্যমাত্রাকে কড়া চ্যালেঞ্জ দিতে চলেছে বাংলাদেশ। হঠাৎ মোড় ঘুরে গেল ম্যাচের। পরবর্তী ওভারগুলোতে মাত্র ৬৫ রানেই বাংলাদেশকে খোয়াতে হল ৯ উইকেট। নেপথ্যে ক্যারিবিয়ান লেগ স্পিনার রাখিম কর্নওয়াল। ক্রিকেটের ইতিহাসে সব থেকে ভারী বোলার। একাই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উইকেট তুলে নেন তিনি।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দেশ অ্যান্টিগুয়ায় ১৯৯৩ সালে জন্ম রাখিম কর্নওয়ালের। ক্রিকেটের মানচিত্রে যে দেশটিকে প্রায় ধরাই হয় না বললে চলে। অ্যান্টিগুয়ারই অখ্যাত ক্রিকেট ক্লাব হকসবিলের হয়ে ২০১৩ সালে প্রথম ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলেন রাখিম। তবে ভালো পারফর্মেন্সের পরেও তাঁর দিকে এগিয়ে আসেনি বড়ো কোনো দল। ক্রিকেটের মাঠে টিকে থাকতে গেলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে দেহের ওজনও। সেখানেই বাধ সাধল। ১৪০ কেজি ওজনের রাখিম কর্নওয়ালের প্রতিভাকে তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখেছিল অধিকাংশ ক্রিকেট টিম।
বেশ কয়েকটি সিজনে ধারাবাহিক ফর্মে থাকার পর এক কথায় ভাগ্য খুলে যায় তাঁর। নজরে আসেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা সিডব্লুআইয়ের। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ‘চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ হিসাবে ঘোষিত হয় তাঁর নাম। আর সেই মাসের শেষেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় দলে দেখা যায় রাখিমের নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে সবথেকে ভারী ক্রিকেটার হিসাবে তৈরি হয় বিশ্বরেকর্ডও।
২০১৯ সালে ভারতের বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টে রাখিমের অভিষেক হয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই তিনটি উইকেট তুলে নেন রাখিম। শিকার হয়েছিলেন পূজারা এবং রবীন্দ্র জাদেজা। সেই ম্যাচের ভাগ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে না গেলেও নজর কেড়েছিল তাঁর বোলিং। দুটি ইনিংসেই ইকোনমি ছিল আড়াই থেকে তিনের মধ্যেই।
তবে ওই যে কৃষ্ণাঙ্গ, তার ওপরে এমন স্থূল চেহারা। ক্রমাগত ম্যাচের পর ম্যাচ স্লেজিংয়ের শিকার হয়ে এসেছেন এই ক্যারিবিয়ান বোলার। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মাঠেও কটূক্তি শুনতে হয়েছে তাঁকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে। দর্শকাসন থেকে উড়ে এসেছে হাসি-তামাসা, হাজারো টিটকিরি। না, মুখ বুজে সবটা মেনে নেননি রাখিম। জবাব দিয়েছেন। তবে মুখে নয়, প্রতিবার সিমে আঙুল রেখে ছুঁড়ে দিয়েছেন লাল অগ্নিগোলক। যা খুঁজে নিয়েছে স্টাম্প কিংবা ফিল্ডারের হাত। লকডাউনের পর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে অনবদ্য ক্যাচ নিয়ে প্রমাণ করেছেন, শরীরের ওজনের সামলেও রিফ্লেক্স বজায় রাখা যায়।
এখনও পর্যন্ত রাখিম প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ৬৫টি। আর তাতেই উইকেটের সংখ্যা ৩১০। মানে গড়ে প্রতি ম্যাচে প্রায় ৫টি করে উইকেট। স্থূলকায় হয়েও যে পরিশ্রমের মাধ্যমে উতরে যাওয়া যায় সমস্ত হার্ডল, তারই প্রমাণ রাখিম কর্নওয়াল। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরেই। টেস্ট ক্রিকেটে এত ওজন নিয়ে খেলা কতটা কঠিন, তা জানেন রাখিম নিজেই। আর সে জন্যই হয়তো প্রতিবার জবাব দিয়ে চলেছেন তিনি সমস্ত হাসি-ঠাট্টা, স্লেজিংয়ের। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, অসম্ভব বলে কিছুই নেই এই পৃথিবীতে…
আরও পড়ুন
এক আশ্চর্য অগ্নিকুণ্ড, যার মধ্যে দিয়ে হেঁটে নিখাদ হল ভারতীয় ক্রিকেট
Powered by Froala Editor