বেশ মন দিয়ে সিনেমা দেখতে বসেছেন। হলে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায়। অবশেষে পর্দায় আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু এখনই যে সিনেমা শুরু হবে না। তার জায়গায় শুরু হবে ‘বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’-এর বিজ্ঞাপন। সিগারেট, তামাক সেবনের অপকারিতা তো আছেই; সেখানে যুক্ত হবে সুরাও। অর্থাৎ কিনা মদ্য, বা মদ। ‘Smoking is injurious to health’-এর মতো এটিও ‘Injurious’ কিনা! কিন্তু রিপু থেকে এত সহজে কি মুক্তি মেলে! আজকের যুগেও মদ্যপান একটি সামাজিক ‘ট্যাবু’। অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে স্বাস্থ্যের হানি হয় সেটা ঠিকই। তবুও আজকের আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়ে মদ নিয়ে আলোচনার পর্দা অনেকটা সরেছে। কলকাতার ইতিহাসের দিকে তাকালে কিন্তু এমনটা দেখা যাবে না। বরং সুরাপান নিবারণের জন্য আলাদা সভাও তৈরি হয়েছিল।
সময়টা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি। ব্রিটিশ শাসন তখন পুরোমাত্রায় কায়েম রয়েছে ভারতে। নিজেদের মতো করে দেশটাকে একটু গুছিয়ে নিতে চাইছে তাঁরা। রক্ষণশীল সমাজের বুকে ইংরেজি আধুনিক ওশিক্ষার ঝড় উঠল। বাংলার যুবক, তরুণরা সমস্ত বাধা দূরে সরিয়ে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে লাগলেন। তার ওপর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের হাত ধরে সমাজকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ধক দেখাতে শিখল বাংলার তরুণরা। দেখতে দেখতে বাড়তে লাগল মদ্যপানের সংখ্যা। আজকের মতো প্রকাশ্যে আলোচনা না হলেও, গোপনে গোপনে একটু ফিসফিস, একটু আড় চোখে তাকানো। সেইসঙ্গে চলত মদবিরোধী প্রচার…
এমন সময় ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। সালটা ১৮৬০। মেদিনীপুরের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু। সেখানকার শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ভোলার নয়। মেদিনীপুর গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে ছিল তাঁর রাজকীয় জীবনযাপন। প্রায়শই মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে মজলিশের আসর বসাতেন রাজনারায়ণ বসু। ছিল দেদার খাবারের আয়োজন; সঙ্গে ছিল মদ। পঞ্চম রিপুর নেশায় গ্লাসের পর গ্লাস উড়ে যেত। হঠাৎই সেসবে ছেদ পড়ল। যেন আকস্মিক এক ঘটনা। কেন? ব্যাপারখানা কী? রাজনারায়ণ বসু স্বয়ং নিজের নীতি বদল করেছেন। ঠিক করেছেন, মদ্যপান ছেড়ে দেবেন তিনি। শুধু তাই নয়, সমাজের বুকে এর কুপ্রভাব নিয়ে প্রচার করতে হবে। তৈরি হল নতুন একটি সভা— ‘সুরাপান নিবারণী সভা’। বাংলার বুকে এমন নিদর্শন এই প্রথম। নানা জায়গায় মদ্যপান বিরোধী প্রচার চলত বটে, কিন্তু আস্ত সভা করার কথা মাথায় আসেনি কারোর।
মদ্যপানের বিরোধিতা করে একসময় অনেক গান রচনা করা হয়েছে। রাজনারায়ণ বসুর এই সভার পক্ষ থেকেও নানা গান রচনা করা হয়। এমন সময় তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ব্রজেন্দ্রনারায়ণ দেব (যিনি সম্পর্কে রাধাকান্ত দেবের পুত্র ছিলেন) এই সুরাপান নিবারণী সভায় এসে যোগ দিলেন। তাঁর বৈঠকখানাও ছিল সুরাপায়ীদের আড্ডাখানা। এমন উদ্যোগে তারাই রীতিমতো ক্ষেপে গেল। তাঁদের মদ খাওয়ার আড্ডা তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর রাজনারায়ণ আর ব্রজেন্দ্রনারায়ণ দুজনেই যথেষ্ট নামী মানুষ। তাঁরা মদবিরোধী প্রচার করলে যদি জোগানে টান পড়ে!
ব্যস, শুরু হল প্রতিবাদ। মেদিনীপুরের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সটান চিঠি লিখে নালিশ জানানো হল। বলা হল, রাজনারায়ণ বসু নাকি কেবল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করার কাজে লেগে আছেন। বিদ্যাশিক্ষার কোনো বালাই নেই। তার ওপর এমন ‘অনাচার’! বাস্তব অবশ্য সম্পূর্ণ উল্টো ছিল। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজনারায়ণের অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। মদ্যপায়ীর ভেবেছিল, এতে তিনি দমে যাবেন। কিন্তু রাজনারায়ণ বসু দমে যাবার পাত্র নন। আন্দোলন আরও জোরকদমে চলতে লাগল। একটা সময় মেদিনীপুরের গণ্ডি টপকে ঢেউ পৌঁছল কলকাতাতেও। ১৮৬৪ সালে প্যারীচরণ সরকার মদ্যপান বিরোধী একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরও বেশ কিছু সভা-সমিতির সূচনা হতে থাকে। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের গানে কিংবা ডি.এল.রায়ের কবিতায় মদ্যপান ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজের প্রতিচ্ছবি পাওয়া গেছে। কিন্তু রোখা যে যায়নি, সেটা বোঝাই যায়। ইংরেজরা তো বটেই, জমিদার ও বনেদিবাবুদের বৈঠকখানায় সাজানো থাকত নানা রকমের সুরা। রিপু কি এত সহজে ছাড়া যায়!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
নিয়মিত মদ্যপান করায় জুটেছিল ‘মাতাল’ পদবি, পরোপকারে নোবেল পেতে পারতেন তাঁরাই