প্রথম দিন সাতটা পঞ্চান্নের শো’য়ে ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমাটা দেখার পর এখনও চোখে ভাসছে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্যের ম্যাজিক, মাথায় ঢুকে পড়েছে সত্যি-মিথ্যের, বাস্তব-পরাবাস্তবের এক আশ্চর্য পেন্ডুলাম। যা অস্থির, অনবদ্য, অস্বস্তিকর। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য-র সিনেমা এমনিতেই ম্যাজিক রিয়েলজিমকে কেন্দ্র করে ঘোরে, বাস্তব ও না-বাস্তবের মাঝখানে ফেলে দেয় দর্শককে। এই না-বাস্তব পরিসরটায় পড়ে দর্শকের রোমাঞ্চ হয়, অস্বস্তিও হয়। এই ম্যাজিকের নাম অবশ্য পরিচালক দিয়েছেন, ‘আশ্চর্য বাস্তব’।
আরও পড়ুন
ঋত্বিকবাবু পরিচালনা করলে 'অযান্ত্রিক'-এ অভিনয় করতে চাই - ঋত্বিক চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার
শরৎচন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাস, কিন্তু তাকে ভেঙেচুরে নিজের আখ্যানে পরিণত করেছেন পরিচালক। এই ছবির শ্রীকান্ত কর্পোরেট চাকুরে। কিন্তু বোহেমিয়ান রক্ত সে মুছে ফেলেনি। গপ্পের ভিতরে অন্য গপ্পের লুকোনো সুতো, তার ভিতরে গপ্পের জাল। আর এই গপ্প বোনার জার্নিকে অসামান্য সঙ্গত করেছে ক্যামেরা। বলা ভালো বাজিমাত করেছে। গঙ্গাবক্ষের ওপর থেকে ড্রোন শটে কতখানি অলীক ধরে নেওয়া যায়, বাংলা সিনেমায় তা করে দেখালেন শুভদীপ দে। সিনেমার অনেকটা শ্যুটিং-ই হয়েছে পুরুলিয়া ও সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে। সেখানে জল ও স্থল - উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ হাতে ক্যামেরা ঘুরিয়েছেন শুভদীপ।‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমায় দুটি ছবি দেখা যায়, একটিতে আর্বান-আধুনিক শহরের প্রেক্ষাপট ও অপরটি ফ্ল্যাশব্যাকে গ্রামের ছবি। এই দুইয়ের মধ্যেই বর্তমান–অতীতের এক উন্মাদ খেলা। যা দেখছি, তার কতখানি সত্যি ও কতখানি মিথ্যে গোটা সিনেমার শেষ তিরিশ মিনিটেও কোনও নির্দিষ্ট উত্তরের সামনে এনে ফেলে না। আর এই শেষ তিরিশ মিনিটেই ধরা থাকে গোটা সিনেমার প্রাণ-জাদু। পরিচালক প্রশ্ন ঠেলে দিয়েছেন আপনার কোর্টে, অস্বস্তি হলেও তার উত্তর নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন আপনিই বা হয়ত পারবেন না কখনওই। সম্ভাবনার দোলাচল আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে আবারও সিনেমার শুরু থেকে শেষে। এ-সিনেমা একবার দেখে ফেললে যেন এক নেভার এন্ডিং লুপের মধ্যে ঘুরে চলাই ভবিতব্য আপনার।
অন্নদাদির চরিত্রে অপরাজিতা যতবার ক্যামেরার সামনে এসেছেন, ততবার মুগ্ধ করেছেন। সারল্যে, গ্রাম্য ভাষায় অপরাজিতা অন্নদাদিদি চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন। ইন্দ্রনাথের চরিত্রে সায়ন অনবদ্য। এই সিনেমার সবচেয়ে বড় পাওনা হয়ত সায়নের অভিনয়ই। শ্রীকান্ত চরিত্রে ঋত্বিক যথারীতি সাবলীল। তাঁকে ব্যবহারও করেছেন বটে প্রদীপ্ত। ছোটো শ্রীকান্তের চরিত্রে সোহম মৈত্রের অভিনয়ও এই সিনেমার প্রাপ্তি। অল্প অল্প ফোলা মুখ নিয়ে হুকুমচাঁদের চরিত্রে রাহুলও অভিনয় করেছেন চুটিয়ে। কোথাও যেন কিছুর অভাব, মুখের হাসিতে তা ধরা পড়বে একটু গভীরে লক্ষ্য করলেই। এসবই বড় অনায়াসে অভিনয়ে বুনে দিয়েছেন রাহুল। আর, রাজলক্ষ্মী চরিত্রে বাংলাদেশি অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিও ভালো। নায়িকাসুলভ চেহারা নয় তাঁর। দর্শকের অভ্যস্ত চোখকে ধাক্কা দেয় পর্দার শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী। জ্যোতিকার অভিনয় নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে তাঁর বাংলা উচ্চারণ খানিক কানে লাগে যেন।
আর, এই সিনেমার সর্বাঙ্গ জুড়ে আছে গান। গান নিজেও গল্প বলেছে। এক সময়ের ফ্রেম থেকে গল্পকে অন্য সময়ে টেনে নিয়ে গেছে। সাত্যকি ব্যানার্জীর আবহ গোটা সিনেমাকে যেন আদর করেছে। গানগুলি ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। সিনেমায় গানের ব্যবহারও চমকে দেওয়ার মতো। মৃত্যুদৃশ্যে ‘আমার এটুক শুধু চাওয়া’ কিংবা বারবার ফিরে ফিরে আসা ‘এমন প্রেমের নদীতে সইগো ডুব দিলাম না’ যেন এক বিস্ময়, চমক আর ঘোরের বিন্যাসে বেঁধে ফেলে দর্শককে। খালি গলায় সোহিনীর ‘আমরা এমনি এমনি ভেসে যাই’ তো ম্যাজিক।
প্রেম-খুন-প্রতিহিংসা-মৃত্যু আর একটা উন্মুক্ত, অস্বস্তিকর, মায়ালীন পথ। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ আসলে এমনই। অন্নদাদি ও ইন্দ্রনাথের মধ্যে যৌনতার এক আলো-আঁধারি মায়াবি দৃশ্য এ সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই সিনেমা কতখানি প্রেমের অথবা কতখানি রাজনৈতিক, সে প্রশ্নও আপনাকে ভাবাবে বৈকি। দেখার পরিসর ছাড়িয়ে আপনাকে নিয়ে এসে ফেলবে এক অন্য বাস্তবে। কিংবা বাস্তবে নয়। কে জানে। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ বাংলা সিনেমাকে যেন আরও কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক করে দিয়ে গেল।
ভাবতে অবাক লাগে, এই সিনেমাই কলকাতায় হল পাচ্ছিল না। মুক্তি পিছোতে হল সাতদিন। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা মুক্তি পেল, তাও শর্তাধীনে। প্রথম পাঁচদিন তেমন দর্শক না হলে সিনেমা উঠে যাবে। দর্শক অবশ্য আসছেন গুটি-গুটি। এই ছবি তো জনস্রোতের ছবি নয়। এর আড়ালে অন্য স্রোত, অন্য ঢেউ। সেইসব ঢেউগুলো যে কবে উত্তাল হয়ে বাংলা চলচ্চিত্র-বাজারের এই নিয়মগুলোকেই ভেঙে দেবে, জানা নেই। তবে, আমাদের পরিচিত বাস্তবটাকে, সিনেমার চেনা ভাষাকে খানিক নেড়ে-ঘেঁটে দেওয়ার যেন এমন সিনেমা যেন বারবার আসে।