হ্যারিসন রোডের ব্যাচেলর মেস থেকে কেয়াতলার নিজস্ব বাড়ি, সত্যবতীর সঙ্গে মন্দমধুর দাম্পত্য এবং ছায়াসঙ্গী অজিত। অবশ্য বাড়ি বললেই বাঙালির পরবর্তী চাহিদা এসে পড়ে একটা গাড়ি। কিন্তু গাড়ি কেনা যে 'হাতি পোষার সমান'। সরকারি বেসরকারি নানা তদন্তের সূত্রে রোজগার মন্দ হয় না, কিন্তু স্থায়ী মাইনের চাকরি তো আর নয়। ব্যোমকেশ তাই খ্যাতির লোভ করে না। বলে, যার যেটা আছে সেটা সে চায় না। ব্যোমকেশ তাই পারিশ্রমিক পেলেই খুশি।
এভাবেই ক্রমাগত পেটি-বুর্জোয়া বাঙালির শ্রেণীচরিত্রকে ভাঙতে ভাঙতে এবং নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে করতে ৩৩টি উপন্যাসে ব্যোমকেশ চরিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ব্যোমকেশ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে আরও নানা চেহারায়। কখনও দুই মলাটের ভাঁজেই অন্য ব্যোমকেশকে হাজির করেছেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী বা শিবরাম চক্রবর্তী। আবার কখনও শরদিন্দুর ব্যোমকেশ ধরা দিয়েছেন সিনেমার পর্দায়। সেই চরিত্রে অভিনয় করে গিয়েছেন বাংলা ও ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় তারকারা। মহানায়ক উত্তম কুমারের পাশাপাশি আমরা পেয়েছি আবির চ্যাটার্জি, যীশু সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ধৃতিমান চ্যাটার্জি, সুজয় ঘোষ, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, এমনকি সুশান্ত সিং রাজপুতকেও। তবু পর্দায় ব্যোমকেশ মানেই যেন দুই সিজনের সেই ভিনটেজ টেলি-উপস্থাপনা। বিশ শতকের শেষ দশক, বলা হয় ভারতীয়দের নস্টালজিয়ার শেষও সেখানেই। দূরদর্শনের ব্যোমকেশ বক্সী তেমনই একটি অন্তিম সময়ের নস্টালজিয়া। লকডাউনের মধ্যে যে স্মৃতি ফিরে এসেছে আবারও।
করোনার দিনগুলিতে দূরদর্শনের ব্যোমকেশ ফিরে এসেছে দুভাবে। প্রথমত, দূরদর্শনের বিভিন্ন ক্লাসিক প্রোগ্রামের মতোই আবারও সম্প্রচারিত হয়েছে ব্যোমকেশ বক্সী। আর দ্বিতীয়ত, এই সময়েই হঠাৎ দর্শকদের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি। তাঁর হাত দিয়েই তো টেলিভিশনে যাত্রা শুরু ব্যোমকেশ বক্সীর। 'ছোটি সি বাত', 'রজনীগন্ধা', 'চিতচোর' প্রভৃতি জনপ্রিয় সিনেমার পরিচালক দূরদর্শনের জগতেও কাজ করে গিয়েছেন সমানতালে। আর কর্মজীবনের প্রায় শেষ দিকেই তিনি তৈরি করলেন ব্যোমকেশকে। ততদিনে ব্যোমকেশকে নিয়ে সিনেমা বানিয়ে নিজেই নিজের নিন্দা করেছেন সত্যজিৎ রায়। তারপর বোধহয় স্বাভাবিকভাবেই আর কেউ অসম প্রতিযোগিতার সাহস দেখাননি। কিন্তু বাসু চট্টোপাধ্যায়ের সাহস একটু বেশিই। আর সেই সাহসের জোরে তৈরি হল ইতিহাস। আজও পর্দার ব্যোমকেশ মানেই রাজিত কাপুর আর অজিত মানেই কেকে রায়না।
তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কী এমন ম্যাজিক জানতেন বাসু? যে ব্যোমকেশ চিরকাল বাঙালি পাঠকের বালিশের পাশে এবং বুকশেলফে থাকতেই অভ্যস্ত, তাকে এমন জনপ্রিয় ভঙ্গিতে পর্দায় উপস্থাপন করলেন কীভাবে তিনি? এই উত্তরটা আছে ব্যোমকেশের চরিত্রের মধ্যেই। ব্যোমকেশ একজন আদ্যোপান্ত মাছে-ভাতে বাঙালি। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন যুবক, অথচ বিলেতিয়ানার লেশমাত্র নেই তাঁর মধ্যে। সমকালের অন্যান্য গোয়েন্দাদের মতো কোট-হ্যাট-পাইপে সজ্জিত নয় ব্যোমকেশ। আর তাই সেই সাধারণের অসাধারণত্বটুকুই পর্দায় ব্যোমকেশকে ফুটিয়ে তোলার সবচেয়ে বড় বাধা। তাই যেখানে একজন উত্তম কুমার ব্যর্থ হয়েছেন, যেখানে একজন সুশান্ত সিং রাজপুতকেও গ্রহণ করেনি দর্শক, সেখানে স্বচ্ছন্দে বাজিমাত করে গিয়েছেন রাজিত কাপুর। বা বলা ভালো, পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়, রেখে গেলেন অসংখ্য কালজয়ী সিনেমা
৪ জুন বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই তাঁর স্মৃতির তর্পণ করছেন। সেইসঙ্গে উঠে আসছে টেলিভিশনের বাসু চট্টোপাধ্যায়ের কথাও। আর সেখানে 'দর্পণ' এবং 'রজনী'র সঙ্গে অবশ্যই বলতে হয় ব্যোমকেশ বক্সীর প্রসঙ্গ। ১৯৯৩ সাল থেকে যে যাত্রাপথ শুরু হয়ে চলেছিল ১৯৯৭ পর্যন্ত। চিত্রনাট্যের ঠাসবুনটের সঙ্গে যার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অসাধারণ চরিত্র নির্বাচন। নানা পার্শ্বচরিত্রে আমরা পেয়েছি রবি ঘোষ, উৎপল দত্তের মতো দাপুটে অভিনেতাকে। অথচ ব্যোমকেশের চরিত্রে অত্যন্ত সচেতনভাবেই নেওয়া হল একজন নবাগতকে। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের চলে গেলেও তাঁর সেই অনন্য সৃষ্টি থেকে যাবে দূরদর্শনের আর্কাইভে। হয়তো আবারও তার দর্শকের আসনে থাকবে নতুন কোনো প্রজন্ম।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বাঙালি পরিচালকের হিন্দি সিনেমা, ফ্লাইট অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় মান্টো-র