“প্রবাসী বাঙালিরা অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতে, ছোটোদের জন্য কলকাতার উপর কোনো ছবি ও ছড়ার বই আছে কিনা। এই নিয়ে আলোচনার সময় তরুণ সাহু বলেছিলেন, আপনারা যাঁরা শিল্পী, তাঁরা কি ছোটোদের কথা ভেবে কখনও ছবি এঁকেছেন? এই কথাটা খুব নাড়া দিয়েছিল। সত্যিই তো আমরা কখনও ভাবিনি ছোটোদের নিয়ে কিংবা কলকাতাকে নিয়ে…”
বলছিলেন শিল্পী তথা ‘হিউমর-ইংক’-এর কর্ণধার উদয় দেব। বিগত বেশ কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিউতি ঘোরাফেরা করছিল বেশ কিছু পোস্টার, টিজার ভিডিও। তাতে ধরা পড়েছিল কলকাতার নানান ঐতিহাসিক স্থানের ছবি। উদয় দেবের (Uday Deb) সঙ্গে দেখা গিয়েছিল কথাশিল্পী রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কেও (Rajatendra Mukhopadhyay)। কিন্তু কীসের এই টিজার? তা এতদিন মোড়া ছিল রহস্যের মোড়কেই। এবার বছরের প্রথম দিনে সেই রহস্যের পর্দা সরিয়ে প্রকাশ্যে এল ‘খেরোর খাতা কলকাতা’ (Kheror Khata Kolkata)। ছড়ায়-ছবিতে পাঠকদের যেন এক অন্য কলকাতার হদিশ দিলেন রজত-উদয়।
শুধু কলকাতাই নয়, আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানাকেও এই বইতে বন্দি করেছেন শিল্পীদ্বয়। খেরোর খাতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আজন্মকালের নস্টালজিয়া। এই বইও তৈরি সেই খেরোর খাতার আদলেই। যার মূল বাঁধন খুললেই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দেবে কলকাতা। হ্যাঁ, মোট পাঁচটি পুস্তিকা নিয়েই গড়ে উঠেছে এই সমগ্র বই-চিত্র। যার কোনোটায় ধরা পড়েছে ‘কলকাতার খাওয়াদাওয়া’, কোনোটায় ‘কলকাতার মূর্তি’। আবার ‘হারিয়ে যাওয়া কলকাতা’ বিভাগে অনুসন্ধান চলেছে কলকাতার বুক থেকে মুছে যাওয়া প্রাণস্পন্দনদেরও।
আরও পড়ুন
কলকাতায় প্রথমবার কার্টুন মেলা, রেবতীভূষণের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা বাংলার কার্টুনিস্টদের
আরও পড়ুন
আত্মপ্রকাশ সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে; প্রয়াত কার্টুনিস্ট ও পরিচালক গৌতম বেনেগাল
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “ছোটোরা এই বইয়ের ছন্দের আনন্দ পেতে পারে। কিন্তু বিষয়গত দিক থেকে এই বই প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্কদের জন্য। যাঁরা কলকাতাবাসী, কলকাতাকে ভালোবাসেন, কলকাতার ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁরাই এই ছড়াগুলির রস আস্বাদন করতে পারবেন।”
আরও পড়ুন
কার্টুনে ঢাকা ক্ষতস্থান, শিশুদের ভয় ঘোচাতে উদ্যোগ চিকিৎসকের
সবমিলিয়ে পাঁচটি খণ্ডে ১২টি করে মোট ৬০টি চার লাইনের ছড়া রয়েছে ‘খেরোর খাতা’-য়। রজতেন্দ্রর লেখা প্রতিটি ছড়ার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছে উদয় দেবের আঁকা ছবি। জানা গেল, দুই ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে এই বই। তবে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা তো থেকেই যায়। দুই মলাটের মধ্যে এই বইকে ধরানোর দায়েই বাদ পড়েছে আরও বেশ কিছু ছড়া ও ছবি। গল্পের ছলেই রজতেন্দ্র জানালেন, “একটা ছবিকেই উদয় পাঁচ রকমভাবে এঁকেছে। যার মধ্যে একটাই নির্বাচন করা হয়েছে। অথচ বাকি চারটেই সমানভাবে প্রকাশযোগ্য। আমরা ভেবেছিলাম আলাদা একটি বই করব। যেসব ছবি বা ছড়াগুলোকে এই বইতে জায়গা দিতে পারলাম না, সেগুলো সেখানে থাকবে।”
তবে ‘খেরোর খাতা কলকাতা’-র অভিনবত্ব এখানেই শেষ নয়। শুধু কন্টেন্টের দিক থেকেই নয়, গ্রন্থসজ্জার সর্বাঙ্গেই প্রাধান্য পেয়েছে বাংলা ছড়া। প্রিন্টার্স লাইন থেকে শুরু করে শিল্পী ও ছড়াকারের পরিচয়, বইয়ের ব্যাগ— সবেতেই ছড়ার ছড়াছড়ি। আরও আশ্চর্যের এই বই, বাঁধাই হয়েছে সম্পূর্ণভাবে হাতেই। অভিনবত্বের ছোঁয়া ছিল বই প্রকাশের অনুষ্ঠানেও। “লেখক বা শিল্পী বছরে একদিন প্রকাশের সঙ্গে দেখা করে রয়্যাল্টি নিয়ে আসেন। এটাই তো হয়ে আসে। কিন্তু যাঁরা বইটা করেছেন তাঁরাই যদি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে বইটা বিক্রি করে? রজতকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি”, জানালেন শিল্পী উদয় দেব। নববর্ষের সকালে গড়িয়াহাটের ‘মেড ইন বেঙ্গল’-এ আজ দেখা গেছে এমনই দৃশ্য। কিন্তু কীভাবে সংগ্রহ করবেন এই বই?
না, কোনো বুকস্টোরে হদিশ মিলবে না ‘খেরোর খাতা কলকাতা’-র। বালিগঞ্জের ‘বাঞ্চারাম’, ‘জগন্নাথ প্রিন্টার্স’ এবং ‘মেড ইন বেঙ্গল’-এ পাওয়া যাবে এই বই। তাছাড়াও কার্টুনে করে এই বই নিয়ে মাসে ছ’দিন কলকাতার বুকে ঘুরে বেড়াবেন গ্রিনট্যাক্সির প্রাণপুরুষ বাপিদা ওরফে ধনঞ্জয় চক্রবর্তী। তাছাড়াও শিল্পী ও ছড়াকার দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই বাড়িতে পৌঁছে যাবে এই বই। পৌঁছে দেবেন স্বয়ং বাপিদাই। উদয়ের কথায়, “বইয়ের ক্ষেত্রে ৩০-৩৫ শতাংশ মার্জিন দিতে হয় বুকসেলারদের। যিনি গাছ এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, সেই বাপিদার হাতেই আমরা তুলে দেব সেটা।” সবমিলিয়ে নববর্ষের আবহে উদয়-রজতের যৌথ চিন্তন বদল আনছে বাঙালির চিরায়ত বই প্রকাশনা এবং বই পড়ার অভ্যাসে। ছড়া-ছবির এই দ্বৈরথে চেনা কলকাতাকেও অনন্য লাগতে বাধ্য যেকোনো পাঠকের। এ যেন এক রূপকথাই বটে…
Powered by Froala Editor