মাত্র বছর দুয়েক আগের ঘটনা। রাজস্থানের যোধপুর শহরে একটি হোটেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য হাজির সিন্ধি সারেঙ্গি বাদক লাখা খান। তবে এর মধ্যেই ঘটে গেল এক অনভিপ্রেত ঘটনা। নিমন্ত্রিত অতিথিকে হোটেলের কেউ খাবার পরিবেশন করলেন না। কিন্তু কেন? আসলে হোটেলের প্রত্যেকের থেকেই তিনি ‘নিচু’ জাতের। আর এই কারণেই কেউ তাঁকে খাবার পরিবেশন করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। বলা হয়, খিদে পেলে পার্কিং প্লেসে বসে খাবার খেতে পারেন তিনি। ক্ষুব্ধ, অপমানিত শিল্পী হোটেল ছেড়ে বিদায় নিলেন সেই মুহূর্তে।
হ্যাঁ, আজও আমাদের দেশে জাতিবিদ্বেষ এতটাই বাস্তব ঘটনা। তবে সেদিনের সেই অপমানিত শিল্পীই আজ দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানের স্বীকৃতি পেলেন। হ্যাঁ, পদ্মশ্রী। গত প্রজাতন্ত্র দিবসেই লোকসংস্কৃতিতে অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পেলেন লাখা খান। সম্ভবত তিনিই একমাত্র জীবিত সিন্ধি সারেঙ্গি শিল্পী। রাজস্থানের এই লোকবাদ্যটির সঙ্গে জড়িয়ে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তবে নানা ইতিহাসই তো মুছে যাচ্ছে। তেমনই মুছে যেত সিন্ধি সারেঙ্গি। তবে শেষ সময় পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন লাখা খান।
পরিবারের সবাই সিন্ধি সারেঙ্গি বাজাতে জানতেন। তাই সেখান থেকেই শিক্ষার শুরু। পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ‘নিচু জাতের’ মানুষ হওয়ায় সেই সুযোগ হয়নি। দুই ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য সেই স্বপ্নও সত্যিই হতে দেয়নি। পরিবার মুসলমান হওয়ায় হিন্দুরা এড়িয়ে চলেন, আবার একসময় এই রাজপুত বংশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মুসলমানরাও স্পর্শ করেন না। অথচ দুই ধর্মের সমাজেই বিবাহ, জন্মদিন সহ নানা অনুষ্ঠানে সিন্ধি সারেঙ্গি নিয়ে হাজির হন লাখা খান। স্পর্শ বাঁচিয়েই চলে অনুষ্ঠান।
এইসব নিয়ে আর খুব বেশি ভাবেন না লাখা খান। খুব তাড়াতাড়ি ভারতের বুক থেকে এই সমস্যা মিটবে না বলেই মনে করেন তিনি। তবে তাঁর জাতীয় স্বীকৃতি যদি আরও কিছু মানুষকে সিন্ধি সারেঙ্গির প্রতি আগ্রহী করে তোলে, সেটাই সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি বলে মনে করেন লাখা খান। আজও তিনি আমেরিকা থেকে ফিনল্যান্ড সর্বত্র অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এগিয়ে এসেছেন তাঁর দুই ছেলেও। তাঁরাও শিখছেন এই বাদ্যযন্ত্র বানানোর কৌশল। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস শেষ হয়ে যাবে না, এতেই খুশি লাখা খান।
Powered by Froala Editor