ভারতবর্ষের ধ্রুপদী সাহিত্যে 'অভিজ্ঞানম্ শকুন্তলম্'-এর কথা বললেই শকুন্তলার অপরূপ রূপ, পৌরাণিক ঘটনার পরম্পরা দেখতে পাই যাঁর ছবিতে, তিনি রাজা রবি বর্মা। রবি বর্মা মানেই ক্যনভাস জুড়ে মানবের জীবন, রং ও মনের তীব্রতা। রাধাকে কৃষ্ণের আলিঙ্গন কিংবা উর্বশীর কমনীয় রূপের বাহার যেন ভারত প্রেমকথার রঙিন কথক। তবে রবি বর্মা মানে শুধুই কিন্তু মহারাজা আইলাম থিরুমলের ছত্রছায়ায় থেকে ছবি এঁকে যাওয়া নয়, ভারতবর্ষের পারসি থিয়েটার (Parsi Theatre), যা কিনা প্রথম বাণিজ্যিক থিয়েটার, সেখানেও তাঁর অবদান সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অতীব মূল্যবান। রবি বর্মার জন্ম ১৮৪৮ সালে, আর পারসি থিয়েটারের জন্ম ঠিক দু-বছর বাদে, ১৮৫০-এ। অর্থাৎ, একটা নব্য সংস্কৃতির যুগে রবি বর্মার (Raja Ravi Varma) বেড়ে ওঠা।
কী ধরনের নাটক হচ্ছে পারসি থিয়েটারে? মূলত পারসি উপকথা 'শাহনামা'র কাহিনি, সংস্কৃত মহাভারতের অংশ, আরব্য রজনী, শেক্সপিয়রের ট্রাজেডি ও কমেডি এবং ভিক্টোরীয় যুগের চটুল নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণে। পারসি থিয়েটারে ইউরোপে ফ্রাংকো-প্রাসিয়ান যুদ্ধের ভাবনাও মঞ্চায়নে নিয়ে আসা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া থিয়েটারের জনপ্রিয়তা পৌঁছে যাচ্ছে দিল্লি, কলকাতা, মাদ্রাজ কিংবা হায়দরাবাদ অঞ্চলে। এমনকি, এই নাটক দেখতে আসছে স্কুল পডুয়া, খালাসি এমনকি বম্বের গৃহভৃত্যরাও।
কেখুস্রো কাবারজি নতুনভাবে পারসি থিয়েটারেকে বিশুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে হিন্দু পুরাণ অবলম্বনে নাট্যকে প্রাধান্য দেন। সময়কাল ১৮৭০, ভালোভাবে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব, বাংলা থিয়েটারের মধ্যেও পুরাণের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। বুঝতে হবে, দেশজুড়ে জাতীয়তাবাদী আবেগের পারদ তখন উর্ধ্বমুখী। এমন সময় থিয়েটারকে আরও জমকালো করে তোলার জন্য নাটমঞ্চকে আর সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। কে আঁকবে হিন্দু দেব-দেবীর চিত্র ? অনুরোধ করা হল রাজা রবি বর্মাকে।
মঞ্চপট বা ব্যকস্ক্রিনে জেগে উঠতে শুরু করল মহাকাব্য কিংবা পুরাণের এক-একটি চরিত্র, এক-একটি ঘটনা। খুব ভালো করে রাজার ছবির দিকে নজর দিলে বোঝা যায়, সেখানে ইউরোপীয় রেনেসাঁ ঘরানার সংলাপমুখর, দ্বান্দ্বিক, ও কেন্দ্রীয় ক্যনভাস দখলকারী নির্মাণ। নল-দময়ন্তী, কিংবা দময়ন্তী ও হাঁস - সমস্ত ছবির মধ্যেই একটা নাটকীয় আঙ্গিক প্রকাশ পাচ্ছে। 'নল-দময়ন্তী' নাটক কাবারজি ১৮৭৬ সালে মঞ্চে নিয়ে আসেন। নাটক শুরুর আগেই ধনী হিন্দু পরিবার থেকে হলে লোক পাঠিয়ে সবচেয়ে সেরা জায়গাগুলি জোগাড় করা হত।
আরও পড়ুন
রক্ত দিয়ে আঁকতেন ছবি! প্রয়াত বিতর্কিত অস্ট্রিয়ান চিত্রকর
বাড়ির স্ত্রী-রা রবি বর্মার ছবির হিন্দু দেব-দেবীর সঙ্গে জীবন্ত নটদের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করত আরাধ্য দেবদেবীকে। যেমন রবি বর্মার 'সরস্বতী' চিত্র। পারসি থিয়েটারে রবি বর্মার ছবি ও নাটকের বিষয়বস্তু অ-হিন্দু শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ ও সংস্কার দুয়েরই কাজ করেছিল।
আরও পড়ুন
আদিবাসী চিত্রকলাকে রক্ষা করতে মহিলা শিল্পীদের সংগঠন হাজারিবাগে
তবে পারসি থিয়েটারেই শুধু নয়, সংগীত-নাটক কিংবা নির্বাক চলচ্চিত্রের পৌরাণিক, আধুনিক দৃশ্যপট তৈরির জন্যও রবি বর্মার ছবি ব্যবহার করা হয়। ঘন রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডকে(যেমন, জঙ্গল) কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরিত্র তৈরি করতেন তিনি, পরবর্তীকালে দৃশ্য অনুযায়ী রচয়িতারা তাঁর ছবি কপি করত। একটা মায়াচিত্র নাটকের টেক্সটের সঙ্গে তৈরি হয়ে উঠত। নাটকের দৃশ্যের দর্শনভাব(প্রেম কিংবা হিংসা) অধিকাংশটাই উন্নত নাটমঞ্চ ও রবি বর্মার মঞ্চচিত্রের সাহায্যে উঠে আসত।
আরও পড়ুন
চিত্রকারের বিচিত্র কথা
এই ব্যাকড্রপ চিত্র চোদ্দোটা ব্যবহার করা হয়েছিল হাফিজ আবদুল্লাহ সাখাওয়াত বাদশাহ-র নাটকে, ১৮৯০ সালে ইন্ডিয়ান এমপিরিক্যল থিয়েটার কোম্পানিতে। মঞ্চের মায়া তৈরি করার জন্য প্রকাশবাদী চিত্রকলার চর্চা রাজা রবি বর্মাকে অনেকখানি সাহায্য করেছিল, তা স্বীকার করতেই হবে। আর এভাবেই, পারস্পরিক পুষ্টিতে, পারসি থিয়েটার ও রাজা রবি বর্মা হয়ে উঠেছিলেন অচ্ছেদ্য।
Powered by Froala Editor