সময়টা ১৮-শ শতক। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের এক কিশোর পড়তে এলেন পাটনায়। বাড়ির বড়োদের ইচ্ছা, ছেলে সুশিক্ষিত হবে। কাজেই নানা ভাষা শিখতে হবে। ভারতের সংস্কৃতিকে জানতে হবে। কিশোরটিও সেইমতো শিখতে শুরু করলেন ফারসি ভাষা। আর তখনকার ভারতে এই শিক্ষার জন্য পাটনার থেকে ভালো জায়গা আর কিছু ছিল না।
অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই আরবি ও ফারসি রপ্ত করে ফেলেন সেই কিশোর। শিখে নেন সংস্কৃত ও ইংরেজিও। পণ্ডিত হয়ে ওঠে সে। সেইসঙ্গে তাঁর মধ্যে তৈরি হয় মুক্তচিন্তার ধারা। সমাজের তথাকথিত নিয়মগুলোর সঙ্গে নিজেকে খাওয়াতে পারতেন না। তখন আর কে জানত, রাধানগর গ্রামের এই বাঙালি ছেলেটিই প্রকাশ করবেন দেশের প্রথম ফারসি সংবাদপত্র! সমাজে নিয়ে আসবেন আধুনিকতা! রাজা রামমোহন রায়ের কাহিনি এমনই বৈপ্লবিক…
তবে আজ রামমোহন রায়ের সমগ্র জীবন নিয়ে কথা হবে না। কথা হবে তাঁরই জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে। তার আগে একটু পাদপূরণ করা যাক। রামমোহন রায়ের সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পর্ক বেশ গভীর। প্রথমত, এতগুলো ভাষায় দক্ষ তিনি। সমস্ত রকম বই চষে দেখেছেন। তার ওপর মুক্তমনা। আস্তে আস্তে অনুবাদের কাজ অল্প বয়স থেকেই শুরু করেন তিনি। বিশেষ করে ফারসি সাহিত্য ও ভাষার ওপর তাঁর অসম্ভব জোর ছিল। সেখান থেকেই ১৮০৪ সালে নিজের প্রথম বইটি প্রকাশ করেন। ফারসি ভাষায় প্রকাশিত বইটির নাম ‘তুহফাত-উল-মুয়াহহিদিন’।
১৮১৫ সালে কলকাতায় চলে আসার পর রামমোহনের নজর যায় সংবাদপত্রের দিকে। ১৮২১ সালে প্রথমবার নিজের পত্রিকা বের করেন, নাম ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’। ইংরেজিতে এর নাম ছিল ‘ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিন’। ওই বছরেই বের করেন ‘সম্বাদ কৌমুদী’। কিন্তু ফারসি ভাষায় একটি সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন রামমোহন। একটা সময় ফারসি ছিল কোর্ট ল্যাঙ্গুয়েজ, অর্থাৎ নবাব-বাদশাহদের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা। পরে শিক্ষিত ভারতীয় ও বাঙালি সমাজও এই ভাষাটি শিখতে শুরু করেন। ফারসি ভাষা শেখা যেন ছিল উচ্চশিক্ষারই এক অঙ্গ। এমনকি, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও বেশ ভালো প্রচলিত ছিল এই ভাষা। মনে রাখতে হবে, তখনও সিপাহী যুদ্ধ হয়নি। কাজেই, ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে থাকলেও দিল্লির মসনদে বসে আছে মোঘলরা।
আরও পড়ুন
রামমোহনকে দুর্গাপুজোয় নিমন্ত্রণ দেবেন্দ্রনাথের, জবাব মনে রেখেছিলেন আজীবন
এমন পরিস্থিতিতেই ১৮২২ সালের ১২ এপ্রিল, নববর্ষের দিন কলকাতায় রামমোহন রায় তাঁর ফারসি পত্রিকা প্রকাশ করেন। নাম ‘মীরাৎ-উল-আখবার’। গোটা ভারতে এই প্রথম কোনো ফারসি সংবাদপত্র প্রকাশিত হল। আর সেটাও হল কলকাতার বুকে, অর্থাৎ বাংলায়। মুদ্রিত হত ধর্মতলা থেকে। নিজের মতামত, ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা-সহ নানা লেখা বের করতে লাগলেন রামমোহন। কোনো রাখ-ঢাক নেই সেখানে। ফারসি ভাষায় পত্রিকা বের করা প্রসঙ্গে রামমোহন নিজে বলেছেন, “… পাঠকগণের মনোরঞ্জনের জন্য এই শহরে অনেকগুলি সংবাদপত্রের সৃষ্টি হইয়াছে সত্য, কিন্তু যাহারা ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত অথচ ইংরেজিতে অনভিজ্ঞ— বিশেষত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লোকেরা— তাহাদের পাঠের জন্য একখানাও ফারসি সংবাদপত্র নাই…” এই কারণের জন্যই ‘মীরাৎ-উল-আখবার’-এর অবতারণা।
আরও পড়ুন
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকারের পক্ষে ‘ক্ষতিকারক’, উঠে গেল রামমোহন রায়ের পত্রিকাও
কিন্তু প্রকাশের পর থেকেই সরকারের বিষনজরে পড়ে গেল পত্রিকাটি। কারণ, এতে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। আর ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই অপরাধ! সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জিনিসটাই শাসকের কাছে ভয়াবহ কিনা! আজকেও যা সত্য, আগেকার দিনেও তা-ই সত্য ছিল। লর্ড হেস্টিংস তো বটেই, উইলিয়াম বেলী নামের এক সাহেবও নাম করে রামমোহনের ফারসি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধাচরণ করেন। ফলস্বরূপ, ১৮২৩ সালে নতুন প্রেস আইন আসার পর সবার আগে বন্ধ করতে বলা হয় ‘মীরাৎ-উল-আখবার’কে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই রামমোহন রায় বন্ধ করে দেন এটি। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করেছিলেন তিনি। দেশের প্রথম ফারসি পত্রিকারও ইতি হয় এভাবে।
আরও পড়ুন
রামমোহন চিঠি লিখলেন বড়লাটকে, সংস্কৃত কলেজে ঠাঁই হল হিন্দু কলেজের
তথ্য ঋণ - বাংলা সাময়িক-পত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
আরও পড়ুন
রামমোহনের ছবি ফেলে দিতে বলেছিলেন অভিমানী বিদ্যাসাগর
Powered by Froala Editor