ছোট্ট একটা জনপদ। পর পর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। তবে লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। তবে এই গ্রামে একবার ঢুকে পড়লেই ধাঁধিয়ে উঠবে চোখ। এ যেন সেই ‘লাল নীল সবুজেরই মেলা...’ বসেছে। হ্যাঁ, সমস্ত বাড়ির দেওয়াল তো বটেই, এমনকি রাস্তাঘাটেও ঝলমল করছে উজ্জ্বল রঙের ছটায়।
তাইওয়ানের (Taiwan) তাইচুং শহরের নিকটবর্তী চাইহং (Chaihong) গ্রামের গেলেই দর্শন পাওয়া যাবে এমন অদ্ভুত দৃশ্যের। অবশ্য স্থানীয় ভাষায় এই গ্রাম পরিচিত ‘রেনবো ভিলেজ’ বা ‘রামধনু গ্রাম’ নামেই। কিন্তু কে বা কারা এত যত্ন নিয়ে সাজাল এই গ্রাম? কী ঐতিহ্যই বা লুকিয়ে রয়েছে এমন অপার্থিব শিল্পকর্মের সঙ্গে?
না, রেনবো ভিলেজের সুদীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে নেই কোনো। বলতে গেলে মাত্র দেড় দশক আগে জন্ম তাইওয়ানের এই বিস্ময় গ্রামের। আরও অবাক করার বিষয় হল, গোটা গ্রামটি একা হাতে সাজিয়েছেন কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি। হুয়াং ইয়ুং ফু। কিন্তু তাঁর হঠাৎ এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণ কী?
প্রাচীনতার দিক থেকে দেখতে গেলে তাইওয়ানের এই গ্রামের বয়স কয়েকশো বছর। তবে বিশ শতকের শেষের দিক থেকেই ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে তার জনসংখ্যা। প্রান্তিক গ্রাম হওয়ায় সেখানে যে চাকরি কিংবা প্রযুক্তির সুবিধা নেই ততটাও। আর সেই কারণে নতুন জীবিকা এবং উন্নত মানের জীবনযাত্রার খোঁজেই একে একে জন্মভূমি ছাড়তে থাকেন গ্রামের বাসিন্দারা। ফলাফল হয় খুব স্পষ্টই। একুশ শতকের শুরুতেই জনশূন্য ‘ঘোস্ট টাউন’-এ পরিণত হয় চাইহং। স্থায়ী বাসিন্দা বলতে অবশিষ্ট ছিলেন কেবলমাত্র দু’জন। প্রাক্তন সৈনিক হুয়াং ইয়ুং ফু এবং তাঁর স্ত্রী।
আরও পড়ুন
বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় ‘জিরেন গুড়’, নেপথ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা
স্বাভাবিকভাবেই গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়তেই উদ্যোগপতিদের নজর পড়েছিল এই গ্রামের ওপর। গোটা গ্রামটিকে বুলডোজারে পিষে নগরায়নের পরিকল্পনাও একপ্রকার পাকাই করে ফেলেছিলেন তাঁরা। তবে বাধ সাধেন হুয়াং। নিজের জন্মস্থানকে শিল্পপতিদের হাত থেকে বাঁচাতে হাতিয়ার করে নেন শিল্পকে। একক উদ্যোগে গোটা গ্রামকে মুড়ে ফেলেন রঙের প্রলেপে।
আরও পড়ুন
জীবিত মানুষদের সঙ্গে মৃতদেরও ‘সরানোর’ লড়াই ইন্দোনেশিয়ার গ্রামে
এসব আজ থেকে ১৪ বছর আগের কথা। আজ হুয়াং-এর বয়স ৯৮ বছর। আজও এই গ্রামের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই বহন করে চলেছেন ইয়ুং ফু দম্পতি। আজও এই গ্রামের বাড়ি কিংবা রাস্তাগুলিতে নতুন করে রঙের প্রলেপ পরে মাঝেমধ্যেই। কখনো বা বদলে যায় ছবিগুলিও। তবে গ্রাম ধ্বংসের আশঙ্কার কালো মেঘ সরে গেছে অনেকদিন।
আরও পড়ুন
গ্রামে আধুনিক চিকিৎসার প্রসার ঘটিয়ে ফোর্বস ইন্ডিয়ার তালিকায় ওড়িশার মহিলা
বর্তমানে গোটা গ্রামটাই পরিণত হয়েছে একটি পর্যটনকেন্দ্রে। ২০১০ সালে হুয়াং-র শিল্পকর্মকে প্রথম সামনে আনেন হুংকুয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিং তুং। তিনিই গ্রামের এমন বিচিত্র ছবি পৌঁছে দিয়েছিলেন সরকারের দরবারে। ছাত্রদের নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘সেভ রেনবো ভিলেজ’ প্রচার। অপ্রত্যাশিতভাবেই তাতে ফল মেলে হাতে-নাতে। বর্ণিল গ্রামটিকে সংরক্ষণের নিদান দেয় সরকার। বাতিল হয় বিলিয়ন ডলারের প্রোজেক্ট। আন্তর্জাতিক সংস্থা লোনলি প্ল্যানেট’ গ্রামটিকে ‘বিশ্বের গোপন বিস্ময়’-এর আখ্যা দিয়েছে। ইউনেস্কোর দরবারেও জমা পড়েছে মনোনয়ন। বলার অপেক্ষা থাকে না, আগামীর ইতিহাসে তাইওয়ানের এই রেনবো ভিলেজের কথা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে…
Powered by Froala Editor