কলকাতার বেতার কেন্দ্র থেকেই স্বাধীনতার খবর প্রথম জানতে পেরেছিল বাংলাদেশের মানুষ

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক সমাবেশ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত গলায় এই ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। দিয়েছিলেন সংগ্রামের ডাক। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ডাক। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করতে। আর সেই সময় তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিল এই শহর। কলকাতা সাক্ষী থেকেছে ’৭১-এর একের পর এক সংগ্রামের। শুধু সাক্ষীই থাকেনি, নিজে সক্রিয়ভাবে অংশও নিয়েছিল।

সেই সময় কলকাতার বেশ কিছু বাড়ি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যেমন ৮ নং থিয়েটার রোডের (শেক্সপিয়র সরণি) একটি বাড়ি, যা এখন পরিচিত ‘অরবিন্দ ভবন’ নামে। ’৭১-এ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতাতে। সেই সরকারেরই প্রধান কার্যালয় ছিল এই বাড়িটা। এছাড়াও ৩/১ ক্যামাক স্ট্রিটের বাড়িটি থেকে ত্রাণ ব্যবস্থা দেখা হত। এইরকম আরও বহু বাড়ি ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতা জুড়ে। তবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাড়িটি অবস্থিত ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। কারণ, এই বাড়ি থেকেই পরিচালিত হত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন এই বেতার কেন্দ্রের অবদানের কথা। দেশের যাবতীয় মানুষকে উজ্জীবিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থাকা, এবং গোটা বিশ্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর পৌঁছে দেওয়ার কাজে এই বেতার কেন্দ্র ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম। প্রথমে অবশ্য চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বেতার কেন্দ্রটির। পরে পাকিস্তানি সেনারা সেটা ধ্বংস করে দিলে অন্যত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন এসে পড়ে। সেই সময়, আওয়ামী লিগের নেতা তাজউদ্দিন আহমদের অনুরোধে ভারত সরকার একটি শক্তিশালী ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার দিল। ব্যস, সেটা দিয়েই নতুন উদ্যমে শুরু হল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

১৯৭১-এর ২৫ মে। কলকাতায় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দোতলা বাড়িতে শুরু হল বেতার কেন্দ্রের কাজ। প্রথমে এটি ছিল মন্ত্রীদের বাসস্থান। পরে বেতার কেন্দ্রের কাজের জন্য তাঁদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় ঢাকা থেকে চলে এলেন আশরাফুর রহমান খান, শহীদুল ইসলাম, তাহের সুলতান প্রমুখ। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকেও কিছু লোকেরা আসেন। সবাই মিলে শুরু করা হয় এক মহাযজ্ঞের। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের দ্বাদশ সেক্টরের কাজ। গানে, নাটকে, ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসীকে ভরসা জুগিয়েছিল এই বেতার কেন্দ্র। আর তা পুরোটাই সংগঠিত হত এই বাড়ি থেকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের সংকেত প্রদান করার কাজও করত এই বেতার কেন্দ্র। শুধু গান, নাটক নয়— নিয়মিত সংবাদ পরিবেশনও করা হত। আর সেটা শোনার জন্য শত বিপদ উপেক্ষা করে মানুষ বসে থাকত রেডিওর সামনে। এরকমই একদিন বালিগঞ্জের বাড়িতে খবর এল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর আসতে পারে। তৈরি থাকল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। একসময় এল সেই খবর। বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রেসকোর্সের মাঠে আত্মসমর্পণ করবে। এতদিনের সংগ্রাম তাহলে সার্থক! অবশেষে স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। দিনটা ছিল ১৬ ডিসেম্বর, এখন যা পরিচিত ‘বিজয় দিবস’ নামে।

দেশভাগ কখনই বাংলাকে আলাদা করতে পারেনি। ওইরকম অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সহায়তা পেয়েছিল কলকাতার। কলকাতার নানা বাড়িতে ছড়িয়ে আছে সেই ইতিহাসের খণ্ডচিত্র। বালিগঞ্জের ওই বাড়িতে আজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনও চিহ্নই নেই। কিন্তু তাই বলে এই এক টুকরো স্বাধীনতা কি করে ভুলে যাবে ইতিহাস? বেতার কেন্দ্রের ‘শানিত ছুরির ধার’ প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধার রক্তে ঢুকে গিয়েছিল। সেই ছোঁয়া কলকাতা কি ভুলতে পারে?

আরও পড়ুন
শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়; আফ্রিকার এই দেশটিরও সরকারি ভাষা বাংলা

Powered by Froala Editor

Latest News See More