রেডিও-র হাত ধরেই সারা বিশ্বে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলা, লকডাউনে বিশেষ উদ্যোগ কলকাতায়

কোয়ারান্টাইনের আবর্তে পড়েছে গোটা পৃথিবী। করোনার ভয়াবহ সময় আমাদের ঘরবন্দি করে রেখেছে। এই আতঙ্ক, এই দুর্বিপাক তো ভীষণভাবে সত্য। কিন্তু এই কোয়ারান্টাইন আমাদের ভাবনার জগতে একটা বিশাল খোলা মাঠও এনে রেখেছে। যেখানে ভিড় করে অনেক না-বলা কথা, চারিদিকে ঘটে চলা ঘটনার ঘনঘটা। সেই কথাগুলো, ভাবনাগুলো যদি সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়! এভাবেই শুরু হল ‘রেডিও কোয়ারান্টাইন কলকাতা’। এমনই অভিনব ও নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে শহর কলকাতার বুকে।

লকডাউনে অনেকেই ঘরে বসে গান তৈরি করছেন, ভিডিও করছেন। ২৫ বৈশাখও ভিডিও-র মাধ্যমেই উদযাপন করা হয়েছে। কিন্তু শুধু ভিডিওই কেন? এই ভাবনা থেকেই মূলত শুরু রেডিও কোয়ারান্টাইনের। গুটিকতক মানুষের নয়, সমাজের প্রতিটা অংশের কথাই যাতে আমাদের মাঝখানে উঠে আসে, সেটাই অন্যতম লক্ষ্য। আমাদের যাবতীয় ভাবনা, রাজনীতি, দর্শন সমস্ত কিছু নিয়েই একটা ভরপুর সমাবেশ। কথাপ্রসঙ্গে রেডিও কোয়ারান্টাইনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা কস্তুরী বসু এমনটাই জানাচ্ছিলেন প্রহরকে। তাঁর বক্তব্য, “আমরা আট-দশজন মিলে যুক্ত আছি এর সঙ্গে। আমাদের ভাবনাটাই ছিল একটা পলিটিকাল-কালচারাল একটা প্ল্যাটফর্মের। যেখানে নিজেদের মতামত দেওয়া যাবে, সবাই সবার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কাজ করবে। এছাড়াও, এই সময় মানুষজন কীভাবে কাটাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা কীরকম সেসবও উঠে আসবে। সেখান থেকেই রেডিওর ভাবনা। এখন ভিডিও এত হচ্ছে, সেই পরিমণ্ডল থেকে খানিক বেরিয়ে আসার জন্যই রেডিও’র অবতারণা। আর এখানে তো শুধু শুনতে হয়, ফলে যাই কাজ করি না কেন, একটা ইনভলভমেন্ট থাকে।”

সচরাচর রেডিও বলতে আমরা যা বুঝি, এটি কিন্তু ঠিক তেমনটাও নয়। এর আসল মাধ্যম হল ইন্টারনেট। আর এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর আটকে নেই ‘রেডিও কোয়ারান্টাইন’। সমস্ত জায়গায়, দেশের সীমা টপকে পৌঁছে যাচ্ছে অন্যান্য জায়গাতেও। তবে এর আসল চমক বোধহয় বিষয় বৈচিত্র্যে। যেখানে উঠে এসেছে সিনেমা নিয়ে আলোচনা, গান, সামাজিক কর্মীদের কথা। এই লকডাউনে যারা কষ্টে আছেন, কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্যও সরাসরি উঠে এসেছে এখানে। কস্তুরী বসু বলছিলেন, “যেদিন লকডাউন শুরু হয়েছিল, তার পরদিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে আমাদের রেডিও। আয়োজন ছিল খুবই সামান্য। আমরা যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা বেশ কিছু সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত। কাজেই, লকডাউনে আমাদের চারিদিকে যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি বা দেখতে চলেছি, সেটা কোথাও গিয়ে সবার সামনে তুলে আনাটা জরুরি বলে মনে হচ্ছিল। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাধ্যম আমরা খুঁজছিলাম। তাঁদের কথা যাতে ঘরে বসেও সবাই শুনতে পারে, সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

অনুষ্ঠানের তালিকা শুনলেই এই অভিনবত্বের সঙ্গে খানিক পরিচয় হবে। যেমন ধরা যাক, ‘কোয়ারান্টাইনের দিনলিপি’। এখানে সেলেব্রিটি হলেন সাধারণ মানুষরাই। এই লকডাউনের সময় তাঁরা কেমন আছেন, কীভাবে চারপাশটাকে দেখছেন সেটা যে কেউ এখানে বলতে পারেন। এছাড়াও এখানে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণও শুনতে পাবেন শ্রোতারা। সামাজিক কর্মী, অধ্যাপক, গবেষকরাও তাঁদের মতামত রাখেন এখানে। তারপর ‘ছোটোদের আসর’, যেখানে ছোটোরাই সবার রাজা। তারাই এখানে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্নভাবে। এছাড়া বিশেষ দিন তো আছেই। সেসব দিনে বিশেষ বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানও হয়। আর প্রতিদিন রাতে গান তো থাকছেই।

এই সূত্রেই একটু ছোঁয়া যাক রবীন্দ্র জয়ন্তী। ২৫ বৈশাখ বাংলার ক্যালেন্ডারে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে যে মানুষটির জন্য, তাঁকে তো অস্বীকার করতে পারি না আমরা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি শুধুই ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণেই সীমাবদ্ধ? এর বাইরে কেবল গান আর চারটে কবিতা আবৃত্তি করলেই সব শেষ? ঠিক সেই ব্যাপারটাই ছুঁয়ে গেছে ‘রেডিও কোয়ারান্টাইন’। ২৫ বৈশাখে তাঁরা দেখতে চেয়েছেন সামগ্রিক রবীন্দ্রনাথকে। এই প্রসঙ্গে রেডিও টিমের অন্যতম সদস্য সুমিত দাস প্রহরকে জানান, “রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনা, সমাজ চেতনা এসব বিষয় তো আমরা খুব কমজনই আলোচনা করি। রবীন্দ্রনাথ মানে তো শুধু কিছু গান নয়। গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়েও তো তাঁর একটা চিন্তা ছিল। তাঁর বিজ্ঞানভাবনাও ছিল। সেসবকে অস্বীকার করে যাওয়া মানে রবীন্দ্রনাথের একটা বড়ো অংশকে গুরুত্ব না দেওয়া। এই সমস্তটা মিলিয়েই তো তিনি। ফলে আমরা এমন একটি রবীন্দ্র জয়ন্তীর কথা ভাবতে শুরু করি, যা একটু অন্যরকম। সেখান থেকেই এই আয়োজন।” ফলে গানের পাশাপাশি শ্রোতারা রবীন্দ্রনাথের নানা খণ্ডচিত্র দেখতে দেখতে এগোন।

ইতিমধ্যে বাংলা ও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে রেডিও কোয়ারান্টাইন কলকাতা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বেও। বাংলাদেশের বেশ কিছু মানুষ তাঁদের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, পরবর্তীতেও নানা বিষয় উঠে আসবে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ অনুষ্ঠানে। এছাড়া ইউনেস্কোর তরফেও রেডিও কোয়ারান্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নিউ ইয়র্কের ব্রিক রেডিও স্টেশনের পক্ষ থেকে গোটা বিশ্বের ৪০টি দেশ থেকে বেশ কিছু কমিউনিটি রেডিও’র শো ব্রডকাস্ট করা হয়। তার মধ্যে ভারত থেকে যে দুটি দল যোগ দেয়, তাঁদের অন্যতম কলকাতার এই অনলাইন রেডিও স্টেশনটি। প্রায় ৫৩-৫৪টি দেশ থেকে নিয়মিত শ্রোতারা হাজির হন এই অনুষ্ঠানে। সবার কথা বলার জন্যই তো আছে রেডিও কোয়ারান্টাইন কলকাতা।