ততদিনে বছর ১৫ পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার। কৃষিনির্ভর দেশ থেকে একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে ভারত। চেষ্টা করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিতে। ১৯৭০ সালেই পৃথিবীকে চমক দিল ভারত। তৈরি করে দেখাল পৃথিবীর বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ। তাও মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই। এমনকি আজও পৃথিবীর সবথেকে সংবেদনশীল রেডিও টেলিস্কোপ এটিই। আর এই কৃতিত্বের নেপথ্যে ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী গোবিন্দ স্বরূপ।
বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। দীর্ঘদিন থেকেই পুনেতে বসবাস করতেন প্রবীণ এই বিজ্ঞানী। গত করেকদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন। গতকাল রাতে প্রয়াত হলেন তিনি। শেষ হল ভারতীয় জোতির্বিজ্ঞানের একটি অধ্যায়। ভারতীয় বিজ্ঞানের গবেষণাকে অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়ার পরেও অনেকটা মেঘের আড়ালেই থেকে গেলেন তিনি। তেমনই যেন নীরব হয়ে রইল তাঁর এই চলে যাওয়া।
১৯২৯ সালে উত্তরপ্রদেশের ঠাকুরওয়াদায় জন্ম। ১৯৫০ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে গবেষণায় যুক্ত হন। বিষয় ছিল সূর্যে ঘটে চলে অবিরত বিস্ফোরণ। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে ডক্টরেট অর্জন করেন গোবিন্দ স্বরূপ। ততদিনে তাঁর দৌলতে তৈরি হয়ে গিয়েছে সূর্যের জাইরো-রেডিয়েশন মডেল। আবিষ্কার করে ফেলেছেন সূর্যের ‘ইউ-টাইপ’ রেডিও বার্স্ট-ও।
১৯৬২ সালে প্রথমবারের জন্য তিনি সামনে আনলেন রেডিও এমিশনের স্টিপ স্পেকট্রাম ব্রিজ। আনুমানিকভাবে নির্ণয় করে দেখালেন রেডিও গ্যালাক্সির বয়স। তাঁর এই আবিষ্কার স্ট্যানফোর্ড তো বটেই, সারা পৃথিবীর মহাকাশবিজ্ঞানে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সুযোগ ছিল স্ট্যানফোর্ডের উন্নত গবেষণাকেন্দ্রে, নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া তাঁর কাজ। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ফিরে এলেন ভারতে।
রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির তখন ভারতে অত্যন্ত স্বল্পচর্চিত একটি বিষয়। এমন একটি ক্ষেত্রে অধ্যায়ন করানোর জন্য তাঁর থেকে ভালো অধ্যাপক আর কে-ই বা হতে পারে? ভারতে এসে সেই দায়ভার নিতে অনুরোধ করেই তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন পদার্থবিদ্যার আরেক কিংবদন্তি হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। গোবিন্দ স্বরূপ ফেরাননি সেই অনুরোধ। দেশের বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ফিরেছিলেন দরিদ্র দেশেই।
দেশে ফিরেই যোগ দিলেন টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে। আর তার ঠিক পরেই শুরু হল ইতিহাস তৈরি কাজ। পৃথিবীর বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ। ১৯৬৫ সালেই। ১৯৬৩ সালেই এই টেলিস্কোপ তৈরি পরিকল্পনা থাকলেও তাতে কিছু বদল আনলেন তিনি। রেডিও-ওয়েভের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যেহেতু অনেকটাই বড়ো হয়, তাই পরাবৃত্তাকার প্লেটের সমন্বয়ে সাজিয়ে ফেললেন নকশা। তাঁর নেতৃত্বে সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতেই তৈরি হল ৫৩০ মিটার লম্বা এবং ৩০ মিটার চওড়া এই টেলিস্কোপ।
আরও পড়ুন
প্রয়াত 'বিষ্ণুপুরের চলমান ইতিহাস' চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত, অসম্পূর্ণই রইল শেষ কাজ
১৯৮০ সালে কোয়াসার, পালসার, রেডিও গ্যালাক্সি এবং কসমোলজির ওপর উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন গোবিন্দ স্বরূপ। ১৯৮৪ সালে তাঁর হাত ধরেই আরও একটি মুকুট জুড়েছিল ভারতের মাথায়। জায়েন্ট মেট্রিওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপের (জিএমআরটি) পরিকল্পনা এবং নীল-নকশা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ২৫ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৩০টি ডিস অ্যান্টেনার ওয়াই আকৃতির এই সারনি ভারতের কাছে জোতির্বিজ্ঞানকে ত্বরান্বিত করার অন্যতম হাতিয়ার।
য়েছেন পদ্মশ্রী, শান্তি স্বরূপ ভাটনাগর, হোমি ভাভা, মেঘনাদ সাহা পুরস্কার। তাঁকে সম্মানিত করেছে ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-ও। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম কতটা মনে রাখতে পেরেছে তাঁকে? হোমি ভাবা যে দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তাঁর কাঁধে, নীরবেই তা পালন করে গেছেন গোবিন্দ স্বরূপ। সম্প্রতি জিএমআরটি টেলিস্কোপের আপগ্রেডেশনের কাজেও যুক্ত ছিলেন গোবিন্দ স্বরূপ। শেষ বয়সেও বিজ্ঞান যেন জড়িয়ে ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। সেভাবে সামনে আসেননি কোনোদিন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার থেকেও বেশি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের ভিত তৈরি করে দিতে এই দেশের মাটিতে। তাই হয়তো অস্ফুটেই বলে উঠেছিলেন, ‘রেডিও-টেলিস্কোপ তৈরিতে আসল কৃতিত্বের দাবিদার ইঞ্জিনিয়াররা।’ রেখে গেলেন ১২৫টি গবেষণাপত্র, এবং অমূল্য কিছু বই। যা নতুন করে দিশা জাগাবে বিজ্ঞান ছাত্রদের...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রয়াত সমাজকর্মী এবং লেখিকা ইলিনা সেন, থেমে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ