শিক্ষক দিবস দিনটার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (Sarvepalli Radhakrishnan)। অনেকেই হয়তো জানেন, রাধাকৃষ্ণনের অধ্যাপক-জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে কলকাতায়। আর, তাঁকে সেসময় অপমানও সহ্য করতে হয়েছে যথেষ্ট! কীরকম? একটু ফিরে দেখা যাক।
তখন ১৯২১ সাল। নব্য যুবক রাধাকৃষ্ণন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'George V Professor of Mental and Moral Philosophy' পদে ভূষিত হলেন। এ-পদে তাঁর আগে আসীন ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। রাধাকৃষ্ণনের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে তখন 'Philosophy of Rabindranath Tagore' বইটি বেশ সাড়া ফেলেছে। তবুও, তাঁর এই উচ্চপদ প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে বাংলার অধ্যাপক মহলে দেখা গেল চাপা অসন্তোষ। ডক্টর হীরালাল হালদারের মতো প্রবীণ অধ্যাপক পড়ে রইলেন লেকচারার হয়ে, আর নবীন রাধাকৃষ্ণনের এহেন উন্নতি ঘটল, এ বিষয়টা অনেকেরই পছন্দ হলো না।
তবে, অসন্তোষ অনুযোগে পরিণত হবার আগেই তা অনেকটা দূরীভূত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণনের অধ্যাপনার খ্যাতিতে, এবং তাঁর মনস্বিতা ও বৈদগ্ধ্যের ক্রমবর্ধমান গৌরবে। স্যার আশুতোষের তিরোধানের পর রাধাকৃষ্ণন পেয়েছিলেন শিক্ষকদের নেতা হওয়ার স্বীকৃতি। যদুনাথ সরকার ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার পর রাধাকৃষ্ণন তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কিছু মানুষের অপ্রীতিকর আচরণে নিজেকে অবিলম্বে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
দর্শন বিভাগের বেশ কিছু প্রবীণ অধ্যাপক, এমনকী অন্যান্য বিভাগের বেশ কিছু অধ্যাপকের অপছন্দের তালিকায় ছিলেন রাধাকৃষ্ণন। কেন? সুকুমার সেন জানাচ্ছেন—"তাঁরা অপছন্দ করতেন আর কোনো কারণেই নয়—অবাঙালী বলেই।" ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের অনুগত ছাত্র সুশীল মৈত্র এবং নারাণবাবু (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়?) অন্তরঙ্গ মহলে রাধাকৃষ্ণনের ঠাট্টার ডাকনাম দিয়েছিলেন 'রেধো তৈলঙ্গি'। একথা কানে ওঠায় রাধাকৃষ্ণন সরাসরি প্রশ্ন তোলেন নারাণবাবুর কাছে। নারাণবাবু হেসে কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলেন, রাধাকৃষ্ণনকে অত্যন্ত কাছের মানুষ মনে করেন বলেই তাঁরা তাঁকে অমন অন্তরঙ্গ ডাকনাম দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এই ব্যাখ্যায় উক্ত নামটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা তীব্র প্রাদেশিকতার গন্ধ ঢাকা পড়ে না।
আরও পড়ুন
বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষকের ভূমিকায় পুলিশ অফিসার
তবে বিরোধিতা কিন্তু কেবল ঠাট্টা-মশকরায় থেমে থাকেনি। মডার্ন রিভিউ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় মীরাট কলেজের অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ হাইকোর্টে মামলা ঠুকেছিলেন রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ? প্লেগিয়ারিজম! সে কীরকম? যদুনাথবাবুর জমা দেওয়া থিসিসের পরীক্ষক হওয়ার সুবাদে সেই গবেষণাপত্রের কিছু অংশ রাধাকৃষ্ণন নাকি হুবহু ছেপে দিয়েছিলেন তাঁর একটি বইতে—এই নিয়ে মোকদ্দমা! সুকুমার সেন (Sukumar Sen) এক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণনের পক্ষ নিয়ে বলেছেন—গবেষণাপত্রের ওই অংশটি একটি সংস্কৃত উদ্ধৃতির ইংরেজি অনুবাদ। তাই দুজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কলমে সে লেখা একইরকম হওয়ায় আশ্চর্য কিছু নেই, বরং হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া রাধাকৃষ্ণন এত ক্ষুদ্র, এত মূল্যহীন ব্যাপারে অন্যের বৌদ্ধিক সম্পদ চুরি করে নিজের মানহানি ঘটাবেন—এ কথাও অধ্যাপক সেন বিশ্বাস করতে নারাজ। বিশ্বাস অবশ্য অনেকেই করেছিলেন, রাধাকৃষ্ণনের বিরোধী পক্ষের অধ্যাপকেরা এই মোকদ্দমায় দারুণ উল্লসিত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য মামলা মিটে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
মাটির দেওয়ালই ব্ল্যাকবোর্ড, প্রান্তিক ঝাড়খণ্ডকে দিশা দেখাছেন স্কুল শিক্ষক
রাধাকৃষ্ণনের সহজ-সরল এবং স্বতঃস্ফূর্ত ইংরেজি লেকচার এতই মনোগ্রাহী ছিল যে, অন্য বিভাগের ছাত্ররাও তাঁর ক্লাসে হাজিরা দিত। এমনকী, মাঝে-মধ্যে যেতেন অধ্যাপক সুকুমার সেন। বিখ্যাত দার্শনিক বসন্তকুমার মল্লিক একবার থিয়োসফিকাল সোসাইটিতে এত দুরূহ বক্তৃতা দিলেন—শ্রোতারা অনেকেই তাঁর বক্তব্য অনুধাবন করতে পারলেন না। কিন্তু তারপর সেই সভার সভাপতি রাধাকৃষ্ণন এত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্যের সারটুকু বলে দিলেন যে, সমবেত শ্রোতারা অনায়াসে তা বুঝতে পারলেন। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে রাধাকৃষ্ণনের বোঝবার এবং বোঝাবার ক্ষমতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন সুকুমার সেন।
ফিলোজফি বিভাগে ড. সরোজকুমার দাশ, ড. অধরচন্দ্র দাশ, হুমায়ুন কবির প্রমুখ অধ্যাপকেরা রাধাকৃষ্ণনের অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। গবেষক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীও তাঁর গুণমুগ্ধ প্রিয়পাত্র ছিলেন৷ কিন্তু নানা অপ্রিয় ঘটনায় কলকাতায় মন বসছিল না রাধাকৃষ্ণনের। তিনি কলকাতা ছাড়লেন।
পরে, রাধাকৃষ্ণন ক্রমে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। বাংলার মনীষীদের তিনি কিন্তু ভুলে যাননি। সুকুমার সেনের সঙ্গে দেখা হলেই শুধোতেন, "How is Suniti?" (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কেমন আছেন?) শিক্ষিত বাঙালি সেনেট হাউস ভেঙে ফেলে নিজের সংস্কৃতির গৌরবময় অভিজ্ঞান ধ্বংস করেছিল, এতেও খুব কষ্ট পেয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণন। সুকুমার সেনের কাছে জানিয়েছিলেন নিজের মনোবেদনা।
সুকুমার সেন তাঁর আত্মজীবনীতে সগৌরবে জানিয়েছেন, রাধাকৃষ্ণন রাষ্ট্রপতি হবার পর মাদ্রাজ থেকে তাঁর যে সংবর্ধনা-গ্রন্থ বেরিয়েছিল, তাতে শ্রীসেনেরও একটি প্রবন্ধ আছে। বাংলার কর্তাব্যক্তিদের অনেকে যে ভুল করেছিলেন, তা সুকুমারবাবু করেননি। রাধাকৃষ্ণনের প্রতি তিনি অকুণ্ঠচিত্তে নিবেদন করেছেন শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসা।
তথ্যসূত্র: 'দিনের পরে দিন যে গেল', সুকুমার সেন
Powered by Froala Editor