নারীকে পায়ের জুতোর থেকে বেশি মর্যাদা না দিলে, সেই নারীর থেকেই কি পুরুষের যৌনতৃপ্তি পাওয়া সম্ভব? অথচ পুরুষ, পরাক্রান্ত পুরুষ, বারেবারে নারীকে অধিকার করতে চেয়েছে। ছলে, বলে, পণ্য হিসেবে রাখতে চেয়েছে নিজের দখলে। নারীকে জুয়াখেলার বাজিও রাখা হয়েছে। এ-সবই আসলে বুঝিয়ে দেয় একটা সমাজে পুরুষ-নারীর সম্পর্ক কীরকম তলানিতে। এহেন সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষয়াটে চেহারা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ঠিক সেখানেই ব্যতিক্রম কৃষ্ণ। তিনি নারীকে অর্থ বা বলপ্রয়োগ করে অধিকার করেননি। আকর্ষণ করেছেন বাঁশির সুরে। এক বিবাহিত নারীর প্রেমকে, তাঁর প্রতি অনুরাগকে মর্যাদা দিয়েছেন। কৃপা করে নয়, ব্যক্তি স্বাধীনতার এই উদযাপনকে তিনি আন্তরিক গ্রহণ করেছেন। একজন স্বাধীনচেতা নারীকে তিনি আপন ছন্দে চলতে দিয়েছেন, পুরুষের পছন্দমাফিক ছাঁচে ফেলে দেননি।
একদা এভাবেই ঝলসে উঠেছিল ইসমত চুগতাইয়ের কলম। রাধার হয়ে নয়, কৃষ্ণের পক্ষে।
কৃষ্ণ তাই নারীসঙ্গলোভী নন। বরং, ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী পুরুষ, যিনি পুরুষতন্ত্রের চেনা ছককেই অস্বীকার করেছিলেন।
আরও পড়ুন
কৃষ্ণ কি সত্যিই মিথ? নাকি সত্য? কী বলছে গবেষণা?
একদা এভাবেই ঝলসে উঠেছিল ইসমত চুগতাইয়ের কলম। রাধার হয়ে নয়, কৃষ্ণের পক্ষে। খ্যাতনামা উর্দু লেখক রামলাল যখন কৃষ্ণ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন, তখন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন ইসমত। নারীবাদী ডিসকোর্সে যে চিঠির গুরুত্ব অপরীসিম। মূল উর্দু থেকে তা অনুবাদ করেন মধু প্রসাদ ও সোহালি হাশমি ( সূত্র - ডেলি ও)। সে-চিঠির ছত্রে ছত্রে চুগতাই বুঝিয়ে দেন, নারী স্বাধীনতার স্বরূপ আসলে কেমন। এবং কেন কৃষ্ণ ব্যতিক্রমী। যেখানে প্রায় সমগ্র ইতিহাসই নারীকে পদানত করার এবং প্রেম ও যৌনতা বিষয়ে স্বাধীনতার অনুশীলন যেখানে বারবণিতা ছাড়া আর কারোর জন্যই প্রায় অনুমোদিত নয়, সেখানে রাধা-কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন অন্যতর সমাজের প্রতীক। চুগতাইয়ের প্রশ্ন, কৃষ্ণের পুরুষভক্তরাও কি নারীর এই স্বাধীনতা মানতে পারবেন? বা, দিতে পারবেন এই মর্যাদা?
চুগতাইয়ের প্রশ্ন, কৃষ্ণের পুরুষভক্তরাও কি নারীর এই স্বাধীনতা মানতে পারবেন? বা, দিতে পারবেন এই মর্যাদা?
এই সমান মর্যাদার প্রসঙ্গ বারেবারেই ফিরে এসেছে চুগতাইয়ের লেখায়। এসেছে এই ভালোবাসার সূত্রে। সিন্থেটিক স্বাধীনতা নয়, চুগতাইয়ের কলম পুরুষ-নারী সম্পর্কের গহীনে স্বাধীনতার আলো দেখতে চেয়েছিল। তাঁর 'আঁচিল' গল্পের রানি, অমন দাপুটে চৌধুরীকেও তাই দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছিল আয়নার সামনে। আদালতে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে, তার সন্তান চৌধুরীর নয়। কারণ, চৌধুরী তো পুরুষই নয়। এই চৌধুরীই তো মাটির ঢেলার বেশি তাকে কিছু ভাবেনি। আমরা বুঝি, আসলে সে যেন গোটা পুরুষ-দাপটেরই প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। যে দাপট কখনওই এই স্পর্ধা স্বীকার করে না। কৃষ্ণচরিত্র ঠিক এখানেই ব্যতিক্রমী। বঙ্কিমের মতো কৃষ্ণের প্রেমকে এড়িয়ে যাননি চুগতাই। বরং, তা ধরেই পৌঁছতে চেয়েছিলেন নারী স্বাধীনতার অন্যতর লোকে। ঘোষণা করেছিলেন, পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যেই স্বাভাবিক প্রেমের এই উদ্ভাসকে এতটা গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এই প্রেম আমাদের প্রার্থিত। প্রার্থিত চুগতাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টি সম্পর্কের আকাশে ফুটিয়ে তুলতে পারে মর্যাদার সন্ধ্যাতারা।