রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান: বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির যাত্রাপথ

রবীন্দ্রোত্তর যুগে ভারতীয় মার্গ সংগীত অথবা আধুনিক গান আমাদের বাঙালি মানুষদের মনোরঞ্জন করলেও, আজও বাঙালির প্রাণের সমূহ আশ্রয় সেই রবীন্দ্রসংগীতেই। এত বৈচিত্র্যময় সমস্ত ঋতুসংহার আর নিত্য নতুন তালের সমাহার আর কার সঙ্গীতেই বা পাওয়া যায়! রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ গান নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ অথবা গ্রন্থরচনার সূচনা যেহেতু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই, তাই বলা যায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে প্রথম সমালোচক রবীন্দ্রনাথ স্বয়ংই। আর তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাঁর অনুজ ধূর্জটিপ্রসাদ ও দিলীপকুমারেরও নাম। এই দুজনের সঙ্গে আলাপচারিতা বা পত্র-বিনিময়ের যে প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়,  তাই দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের একটা সঠিক রূপরেখা পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর থেকে রবীন্দ্রশতবর্ষের কাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক গ্রন্থ একদম অপ্রতুল। যে সমস্ত বই পাওয়া যায়, তারমধ্যে শান্তিদেব ঘোষকৃত 'রবীন্দ্রসংগীত' গ্রন্থটিকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থটি ছাড়া অন্যান্য যে-সমস্ত গ্রন্থ এই সমকালীন সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি মূলত রবীন্দ্রসংগীতের  বিষয়ে সিলেবাস অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক আলোচনাই। আর একটি জিনিস লক্ষণীয়, সেইসব গ্রন্থের লেখকেরা সবাই প্রায় সঙ্গীত শিল্পী অথবা রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের এবং বিভিন্ন অঙ্গের গান, রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট বিভিন্ন তাল ও ছন্দ বা গানে ব্যবহৃত কিছু রাগরাগিণীর পরিচয়ই ছিল সেই সমস্ত গ্রন্থের একমাত্র বিষয়। কিন্তু কোনো তুলনামূলক গ্রন্থ সেইসময়ে রচিত হয়নি। 

সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা রবীন্দ্রগান বিষয়ে নানা গ্রন্থ রচনা করছেন তাঁরা কিন্তু অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতের গায়ক বা শিক্ষক নন। এঁরা কেউ কবি বা শিক্ষক, সাংবাদিক। আবার কেউ হয়তো-বা বুদ্ধিজীবী কিন্তু সকলেই রবীন্দ্রগানে মজেছেন। তাঁদের কাছ থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে সবচেয়ে মূল্যবান মূল্যায়নগুলো পেয়েছি। এঁদের লেখায় অসামান্য সব তথ্য ও এক একটি গানের ইতিহাসও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তাঁদের কলম শুধু তথ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর অন্তঃস্থলের সায়রে অবগাহন করে শাশ্বত সত্যের প্রকাশ করেছেন। তাঁর লেখা গানের কথার সঙ্গে সুরের যে অবধারিত মিলন সেটির নির্মাণ সম্পর্কে লিখে আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছেন। আধুনিক কালে রচিত এইসব গ্রন্থে অজস্র তথ্য যেমন আছে, তেমনি তত্ত্বও আছে। যা পরবর্তীকালে রবীন্দ্র-গবেষকদের সহায়ক হতে পারে। 

রবীন্দ্রনাথের সংগীতজীবনে সর্বমোট ১১২টি বর্ষা অঙ্গের গান। যা তিনি রচনা করেছেন ষোলো বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রায় ১৯৪১ সালে মৃত্যুর-প্রাক্কাল পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বর্ষার গানটি রচনা করেন তাঁর ষোলো বছর বয়সে। বৈষ্ণব পদাবলির অনুসরণে ভানুসিংহ ছদ্মনামে ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদ ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ হল তাঁর লেখা প্রথম বর্ষার গান। এরপরে বেশ কিছুকাল বিরতির পরে একুশ বছর বয়সে রচনা করেন ‘গহন ঘন ছাইল’ দ্বিতীয় বর্ষার গানটি। গানটি ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যে ব্যবহৃত হয় এবং সম্ভবত নাটকের প্রয়োজনেই পূর্ববর্তী কোনো হিন্দি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদর্শে রচিত।  রবীন্দ্রনাথের প্রথম বর্ষার গানটি তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছেও ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। বোঝা যায় সেইসময়ে রবির কবিখ্যাতির চেয়েও গীতিকার সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল। এরপরে 'গহন ঘন ছাইল' গানটির পরে দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ কোনো বর্ষার গান রচনা করেননি। 

বর্ষাকে নতুন করে দেখার জন্যে ছিল তাঁর কত রকমের পরিকল্পনা। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার চাপানউতোরে বাইশে শ্রাবণ নিয়ে যেন সেই তুলনায় মনের দুয়ার খুলে দেবার অবকাশ ছিল অনেকটাই কম। বাইশে শ্রাবণের গান বলতে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘চিরসখা হে’ অথবা ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’-র মতো কিছু গানের বাইরে যেন কিছু ভাবাই চলে না। কেন? মৃত্যু কী এতই ক্ষুদ্র ও সীমিত যে তাকে ‘শ্যামসমান’ বলা যায় না! বিরহ, বিচ্ছেদ, ক্ষয়ও কী এতটাই স্থূল যে তার মধ্যে মহামিলনের আশা থাকে! শ্রাবণ আকাশের মেঘমেদুর বিশাল ব্যাপ্তির মাঝে কি তার অনন্ত রূপের আস্বাদ মেলে না বিচিত্র ছন্দে? ঝরঝর বর্ষণের বিরামহীন বর্ষাকাল কবির মনোজগতে প্রেম, বিরহ, সুখ দুঃখ, সংকট সবই নিয়ে হাজির ছিল। এর প্রমাণ দেখা যায় তাঁর বর্ষা অঙ্গের গানগুলোতে। 

“কথা জিনিসটা মানুষেরই, আর গানটি প্রকৃতির। কথা সুস্পষ্ট এবং বিশেষ প্রয়োজনের দ্বারা সীমাবদ্ধ আর গান অস্পষ্ট এবং সীমাহীনের ব্যাকুলতায় উৎকন্ঠিত। সেই জন্যে কথায় মানুষ মনুষ্যলোকের এবং গানে মানুষ বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মেলে।

আজ এই ঘনঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারে ভাষা আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলতে চাচ্ছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করবে বলে আমাদের দ্বারে এসে আঘাত করছে। আজ গান ছাড়া কোন কথা নেই।”  

এই কথাই কবি 'শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ নিবন্ধে লিখেছিলেন। তাঁর রচিত শ্রাবণের গানগুলো যেন তাঁর গভীরতম চেতনার প্রকাশ। 

রবীন্দ্রনাথের ষোল বছর বয়সে লেখা প্রথম শ্রাবণের গানটি ছিল বৈষ্ণব পদাবলির অনুসরণে ‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনী রে’। নিজে সপরিবারে ব্রাহ্ম ধর্মে বিশ্বাসী হলেও মণিপুরের বৈষ্ণব সংস্কৃতি তাঁর বরাবরের পছন্দের ছিল। এতটাই মণিপুরী সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মানসিক বন্ধন ছিল যে, 'চিত্রাঙ্গদা' গীতিনাট্যে নাম-চরিত্রটিও মণিপুরের পুরুষবেশী শিকারী হিসেবে রাজকন্যাকে লেখেন। পরবর্তীতে এও দেখা যায় মণিপুরী নৃত্যশৈলীর মুদ্রাও তিনি রবীন্দ্র-নৃত্যে যুক্ত করেন। 

‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ গানটিতে শ্রাবণের বরষণ মুখর রাত্রিতে রাধার অভিসার বর্ণনা আছে। যদিও ষোলো বছরের কিশোর রবির লেখা এই গানে পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণী-ভাবনার উপলব্ধিকে প্রত্যাশা যায় না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘ভানুসিংহ’ নামের আড়ালে লেখা এইসব সৃষ্টি সম্বন্ধে একটু কুণ্ঠিতই ছিলেন পরবর্তীতে। কিন্তু গান যদি সুরে আর অভিব্যক্তিতে ব্যঞ্জনাময় হয়, তাহলে মানুষ আপন করেই নেয় শ্রুতিমধুর সেই গানকে।

এই গানটি বিভিন্ন সময়ে গেয়েছেন অনেক শিল্পী।  রবীন্দ্রসঙ্গীতের অগ্রণী শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ করে বলতে হয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডিংটির কথা (১৯৪৭)। উৎকণ্ঠিতা রাধার ব্যাকুলতা আর উদ্বেগই যেন গুরুত্ব পায় তাঁর পরিবেশনে, তাই ‘মোতিম হারে বেশ বনা দে’ অংশেও লাগে এক স্নিগ্ধ গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। সাজের প্রয়োজন নেই, তবু যেন নিয়মরক্ষার সাজ করছেন নায়িকা। ১৯৫৩ সালে ‘বউঠাকুরানীর হাট’ ছবিতে এই গানটি আবার ব্যবহার করা হয়। সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

এ গান তো শুধু রাধার নয়, কবির ছদ্মবেশে ভানুরও। তাঁর চোখেই ধরা পড়েছে অভিসারিকা রাধার পরমা রূপ। এ গানে রাধার প্রেমাস্পদ না হয় ‘নিরদয় কান’, কিন্তু তাঁর পূজারী-প্রেমিক তো কবি নিজেই। রাধা তাঁর চোখে অখিল সোহাগিনী, বিশ্বব্যাপী মাধুর্যের পরমা। আর এই প্রেমের জোরেই ‘দাস’ ভানু বলতে পারেন, ‘ন জাওব বালা নওল কিশোরক পাশ’ – যেও না মেয়ে, এমন দুর্যোগের রাতে যেও না তার কাছে। কতখানি ভালবাসা থাকলে রাধার কষ্টের কথা ভেবে তাঁকে এমন করে কৃষ্ণের কাছে যেতে বাধা দেওয়া যায়! এই প্রেম তো পুজোরই নামান্তর— যে ভাব রবীন্দ্রনাথের সারা জীবন জুড়ে লেখায়, সুরে বিকশিত হয়েছে ক্রমে নিকষিত হেম রূপে।

সম্ভবত সত্তরের দশকে লন্ডনে নিশীথ গাঙ্গুলির বাড়িতে গানটি শুধু হারমোনিয়ামে ঘরোয়া পরিবেশে গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হিন্দুস্তানি উচ্চারণ নয়, বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত যেভাবে গাওয়া হয় সেভাবেই গেয়েছেন, হয়তো সচেতন ভাবেই। মিশ্র ব্রজবুলি ভাষায় লেখা হলেও মূলে তো এ গান রবীন্দ্রসঙ্গীতই। কণিকার রেকর্ডিং-এও এই বাংলায় টান ও উচ্চারণই যথেষ্ট সমাদৃত হয়। 

ভানুসিংহের মানসী এই ব্রজভাষায় কথা বলা রাধার প্রকৃত আকুতিকে আমরা সঠিকভাবে পাই এই কিছু বছর আগে মাত্র। ভাবতে বিস্ময় লাগে। লাইভ রেকর্ডিং-এ নতুন করে যন্ত্রানুষঙ্গ যুক্ত করে ২০০৬ সালে আবারও গানটির সফল প্রকাশ করল সাগরিকা রেকর্ড কোম্পানি। মল্লারের অনবদ্য আবহ ধরা দিয়েছে শিল্পীর কণ্ঠে ও সঙ্গতে।  শুনলে মনে হয়, একই কণ্ঠে রাধা এবং কৃষ্ণ গাইছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অর্ধনারীশ্বর রূপ যেন সুধা হয়ে বৃষ্টি ধারার মত ঝরে পড়ছে মুগ্ধ শ্রোতার প্রাণের গহনে।   

রবীন্দ্রনাথের কাছে শ্রাবণ ছিল সমগ্র বর্ষার জীবন্ত এবং সাকার রূপ। তাঁর জীবনে বাইশে শ্রাবণ যে শুধু এক গভীর শোকের কারণেই স্মরণীয়, তাও তো নয়। কবি তখন শিলাইদহে। সালটা ছিল ১৮৯৪। তারিখ বাইশে শ্রাবণ। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীকে চিঠি লিখেছেন কবি— “...এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক। ...জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গুপ্ত, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখনকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে। এখনকার দিনগুলো তার সেই অনেক কালের পদচিহ্ন দ্বারা যেন অঙ্কিত।” (ছিন্নপত্র)

১৩২৯ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ কবি শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল উৎসব পালন করেছিলেন। সেদিনটা সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টির ঝমঝম। 

"আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে" গানটি সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি নিজকণ্ঠে গেয়েছিলেন, আবৃত্তি করেছিলেন 'ঝুলন’, ‘বর্ষামঙ্গল’, ‘নিরুপমা' এইসব বর্ষার কবিতা। প্রতিবছর শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল উৎসবকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান রচনা করে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। 

১৩৪৬ বঙ্গাব্দে বর্ষামঙ্গলের জন্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের অনুরোধে অনেকগুলি গান লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রসঙ্গে শৈলজারঞ্জন লিখেছেন, “১৯৩৯ সন। বর্ষামঙ্গলের প্রস্তুতি চলছিল।... আমি গুরুদেবকে বললাম যে, ছেলেমেয়েরা বলছে নতুন গান চাই, পুরানো গানে ওরা আর বর্ষামঙ্গল করবে না। গুরুদেব বললেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে কি করে আর নতুন গান লেখা যায়।... পরদিন বেলা এগারোটায় গুরুদেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নতুন লেখা একটি গান হাতে দিলেন। গানটি — ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’।

দ্বিতীয় গান ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল’ পেলাম তার পরের দিনেই।... 

পরের দিন আবার কাগজে লিখে দিয়ে এলাম, ‘ইমন’, পেলামও- ‘এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও’ গানটি। (‘যাত্রাপথের আনন্দগান’) এভাবেই একে একে লেখা হয়েছিল ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, ‘সঘন গহন রাত্রি’ প্রভৃতি।"   

এই গানগুলোর মধ্যে বিশেষ করে কয়েকটি তো বাঙালির পরম প্রিয় কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে অমর হয়ে আছে। ‘এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও’ গানটির কথাই ধরা যাক। দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছেন তাঁর মন্দ্রসপ্তক-নির্ভর নিনাদে। ‘নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা’ গাইবার সঙ্গে সঙ্গে যেন জমাট অন্ধকারের মঝে এক পশলা বৃষ্টির আমেজ। ‘বিজন ঘরের কোণে’, ‘কালো ছায়া’ শব্দবন্ধের উচ্চারণে শ্রাবণ সন্ধ্যার নির্জনতার ছবিখানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটু একটু করে। বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অন্তরালে এই একা হতে পারার, নিজেকে খুঁজে পাবার এক গভীর চেতনা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর পরিবেশনায়।  

গানটি দূরদর্শনে গেয়েছেন সাগর সেন, আর আকাশবাণীতে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। দুটি পরিবেশনাই মনোজ্ঞ ছিল। পরে এই গান আবারও গেয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, আশিস ভট্টাচার্য প্রমুখে।        

হেমন্ত গেয়েছেন ১৯৭০ সালে এক অনাড়ম্বর অথচ অতলস্পর্শী ‘সঘন গহন’ ডাক দিলেন, ‘এসো গো... চমকে তাকাল শ্রোতা, সাড়া দিল তাঁর সমগ্র চিত্ত.. এখানেও শিল্পী বহিরঙ্গে আত্মগত, একা— কিন্তু অন্তরঙ্গে তিনি এক অপার্থিব সংলাপ রচনা করে চলেন যেন এক পরম বাঞ্ছিতের উদ্দেশে— যার জন্য তাঁর ‘নিভৃত প্রতীক্ষা’ এমন অপরূপ হয়ে ওঠে। বর্ষার রাতে বাঁশি শুনে যেমন প্রত্যেক গোপিনী ভেবেছিলেন, এ বাঁশি কেবল তাকেই ডাকে। এ গানে অবশ্য ‘হারিয়ে গেছে মোর বাঁশিখানি, আমি কোন সুরে ডাকি তোমারে’...

যখন সজল হয় বাতাস, তখন মনে হয় এমন গানেই বুঝি মিশে যায় পুরুষ এবং প্রকৃতি, চিরবিচ্ছেদের, বেদনার অন্তরালে এই নিবিড় মিলনের জন্যই তো বার বার ফিরে এসে বলা— ‘আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’

১৮৮২-র পর ১৮৯৫-এর সেপ্টেম্বর মাসে রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় বর্ষার গান 'ঝর ঝর বরিষে বারিধারা', শিলাইদহে স্টিমারের খোলা ছাদের ওপর বসে অবিরাম ঝড় বৃষ্টিবাদলের আবহে। কিন্তু তৃতীয় এই গানটিকে রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম স্বকীয় বর্ষাসংগীত বলে গণ্য করা যেতে পারে। এই গানে বৈষ্ণব পদের অনুকরণ নেই। এছাড়া  দ্বিতীয় গানটির মতোও হিন্দি ও ভাঙা খেয়ালের সুর গানের আধার হয়নি। বিস্ময় জাগে, কেন এই গানের পূর্বজ পাঁচ শতাধিক গানের মধ্যে একটিও বর্ষার গান আমরা পাই না। দেখা যায় যে, ঠিক গীতাঞ্জলি পর্বের আগে বা সম-সময়ে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের ঢল নামে। গীতাঞ্জলিতেই আমরা মোট একুশটি বর্ষার গান পাই। এর মধ্যে একটি গানের সুর পাওয়া যায় না। গানটি 'আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে'। 

রবীন্দ্রপূর্বকালে বর্ষার গানে নানা প্রকার মল্লার বা দেশ রাগের সুর ব্যবহার করা প্রথাসিদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথের পূর্বজ সুরকাররা এই ঐতিহ্যকে বহন করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথই সম্ভবত প্রথম এই ঐতিহ্যকে ভেঙেছেন, নিজের ইচ্ছেমতো সুর, তালে, ছন্দে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এমনকি রাঢ় অঞ্চলের লোকসঙ্গীত ঝুমুর গানের প্রভাবও তাঁর গানে পাওয়া যায়। বিশিষ্ট ঝুমুর গান শিল্পী ভরত মাহাতোর একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে পারি এই তথ্যটি।

প্রথা ভেঙে নতুনকে গ্রহণযোগ্য করে নেয়ার ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বরাবর ছিল। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে আমরা তাই প্রচুর পরিমাণে ইমন ভৈরবী বেহাগ প্রভৃতি রাগের সুরের এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও কীর্তন সুরেরও প্রয়োগ পাওয়া যায়। এই ধারাটিও কিন্তু তাঁর অচলায়তনকে ভাঙার একটি পদক্ষেপ ছিল। তাঁর প্রত্যয়ী সুরের প্রথম বর্ষার গান ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল’। এটি বর্ষার কোনো রাগে নয়, বরঞ্চ ইমন কল্যাণের আধারে রচনা করেন। গানটি গীতাঞ্জলি পর্যায়ের রচনা, যখন রবীন্দ্রনাথ সুরযোজনার সনাতন পন্থা ছেড়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠছেন।

রাগাঙ্গ সম্পূর্ণত প্রকাশ পায় না বলেই একসময়ে রবীন্দ্রনাথের গান শাস্ত্রীয় সংগীতবিদদের কাছে অনাদৃত ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সুরের প্রবল নিজস্বতা ছিল। প্রসঙ্গত, তাঁর আরও একটি আকর্ষণীয় বসন্তের বিখ্যাত গান, ‘বাসন্তী হে, ভুবনমোহিনী’ গানটিও তিনি প্রবলভাবে কর্ণাটকী রাগসঙ্গীতের ঘরানায় রচনা করেন। শুধু বর্ষা নয়, রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি গান নিয়েই সুর, তাল ও রাগের এক্সপেরিমেন্টে মেতেছিলেন সারাটি জীবন।  

এমনকি বেশ কিছু গানে তিনি পাশ্চাত্যের সুরেরও আরোপ করেছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথের গান যেমনভাবেই পরিবেশিত হোক না কেন, কণ্ঠে বা যন্ত্রে, সুরটিকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বলে তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এমনকি বিশুদ্ধ রাগরাগিণীতে আধারিত রবীন্দ্রসংগীতের বেলাতেও একই কথাই খাটে। এস্রাজে 'কার বাঁশি নিশিভোরে' গানটি বাজলে কিংবা গিটারে 'মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি' তাকে জৌনপুরী বা ভৈরবী কোন বন্দিশ বলে ভুল করবে না। তৎক্ষণাৎ এই সব সুরকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বলে চিহ্নিত করা যায়। বাণীর সহযোগ ছাড়া তাঁর গানের সুরের একটি নিজস্ব ঘরানা আছে। রাগরাগিণী তাঁর রচিত গানে কতটা জায়গা পেয়েছে কিনা অথবা তাঁর রচিত সুরটি কোন রাগের কিনা, তারও ঊর্ধ্বে গিয়ে সঙ্গীতজগতে রবীন্দ্রসংগীত স্বতন্ত্র।

Powered by Froala Editor