সময়টা ১৯২১ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় বিপর্যস্ত জার্মানি। ইউরোপের সমস্ত শক্তিধর দেশ তখন তাকে বয়কট করেছে। ঠিক এই সময় বার্লিনের মাটিতে পা রাখলেন এক সাদা জোব্বা পরা ভারতীয়। নামটা বোধহয় আন্দাজ করা কঠিন নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিকে সেদিন জার্মানির মানুষ যেভাবে আপন করে নিয়েছিলেন, সেটা সত্যিই অবাক করে। অবশ্য তার পিছনে ছিল একটা মজার কারণ। কলকাতার ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথকে নাকি সেদিন ইহুদি ভেবে ভুল করেছিলেন অনেকেই। আর তাঁকে গরিবগুর্বো ইহুদিরা ডেকেছিলেন ‘রাব্বি’ নামে। যে নাম খাঁটি ইহুদি নাম। রবীন্দ্রনাথ সেই ভুল ভাঙাননি। হয়তো সেদিনই সেই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’।
তবে এই আন্তরিকতা কতদূর অগ্রসর হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও ২১ বছর পরে। যখন নাৎসি আগ্রাসনের মুখে বিপর্যস্ত সমস্ত ইউরোপ। আর ইহুদি নিধন যজ্ঞের বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে জার্মানির বাইরেও। এই ঘটনাটা অবশ্য ঘটেছিল পোল্যান্ডের বুকে। ১৯৪২ সাল, পোল্যান্ড তখন পুরোপুরি নাৎসি সেনাদের দখলে। ৩৫ লক্ষ ইহুদি জানেন না আদৌ এই সময় পেরিয়ে যেতে পারবেন কিনা। ধরে ধরে মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হয় তাঁদের ক্রীতদাসের মতো খাটানো হচ্ছে, আর নয়তো মেরে ফেলা হচ্ছে।
সেইসময় পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরের বুকে একটি অনাথ-আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন ইয়ানুস কোরচাক নামে এক ব্যক্তি। তাঁর আশ্রমের প্রায় ২০০ বালক-বালিকার সকলেই ইহুদি। তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইহুদি ঘেটোতে। ঘেটো মানে বিরাট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জেলখানা। সেই সময়েও শিশুদের হাত ছেড়ে দেননি কোরচাক। তিনিও আশ্রয় নিলেন সেই ঘেটোর মধ্যেই। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ত্রেবলিনকা মৃত্যুকূপে। কাউকে আবার প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। তাঁদের একমাত্র অপরাধ তাঁরা ইহুদি।
মৃত্যু আর বেশি দেরি নেই। এই সত্যিটা বুঝতে সময় লাগেনি। আর এই মৃত্যুচেতনার মধ্যে সেদিন আবারও আশ্রয় দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি নিজে ততদিনে পাড়ি দিয়েছেন সেই পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নিচে, শ্যামলী নদীর ধারে – আর এই অসহায় শিশুদের গন্তব্যও সেখানেই। খুব শিগগিরি। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন কোরচাক। কিন্তু এই শিশুরা! এদের তিনি প্রস্তুত করবেন কীভাবে? ঠিক করলেন সেই ইহুদি ঘেটোর মধ্যেই একটি নাটক অভিনয় করাবেন শিশুদের দিয়ে। কী সেই নাটক? নাটকের নাম ‘পোচতা’। পোলিস ভাষায় যার অর্থ ‘ডাকঘর’। হ্যাঁ, ১৮ জুলাই ১৯৪২, রবীন্দ্রনাথের সেই অমল আর দইওয়ালার কথোপকথনের সাক্ষী ছিল সেদিন ঘেটোর মধ্যে মৃত্যুর জন্য দিন গুনতে থাকা অসংখ্য মানুষ। যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী অমল তার নিশ্চিত ভবিষ্যতকে গ্রহণ করেছে আবিষ্কারের আগ্রহে। নাটকে অবশ্য অমল তার কাঙ্খিত রাজার চিঠি হাতে পায়নি। কিন্তু ইহুদি ঘেটোর সেই শিশুরা শমন পেল কিছুদিনের মধ্যেই। ৬ আগস্ট ১৯৪২, অর্থাৎ নাটকের অভিনয়ের ঠিক আড়াই সপ্তাহ পর কোরচাক, তাঁর সমস্ত সহকর্মী এবং ১৯৫ জন অনাথ বালক-বালিকাকে চলে যেতে হয় ত্রেবলিনকায়।
আরও পড়ুন
‘এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে’, ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
অদ্ভুত এক দৃশ্যের সাক্ষী ছিল সেদিন নাৎসি বাহিনী। কোরচাকের পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্ত বালক বালিকা। একে একে তারা এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুকূপের দিকে। কারোর চোখেমুখে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই। মৃত্যুকে তারা গ্রহণ করেছে সহজ ভাবেই। আর সেই নির্ভীক দৃষ্টি যেন আবারও রবীন্দ্রনাথের সেই কথাই মনে পড়িয়ে দেয়, ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়’।
আরও পড়ুন
’৬২-র যুদ্ধে নাজেহাল ভারতের পাশে পাকিস্তান, সুদূর ইরান থেকে চিঠি এল নেহরুর কাছে
‘ডাকঘর’, একটা জীবনের গল্প। রাজনীতির কোনো লেশ নেই। অত্যাচার নেই, বিদ্রোহ নেই। আছে শুধু টুকরো টুকরো কিছু ছবি। আর সেই ছবিই এক অক্ষয় স্বপ্নের রাজ্য তৈরি করে দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কি উপলব্ধি করেছিলেন একদিন ইহুদিদের শাণিত অস্ত্রের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে তাঁর এই নাটকটাই? হয়তো করেছিলেন। ১৯২৬ সালে যখন কবি দ্বিতীয়বার জার্মানিতে গিয়েছিলেন, তখন হিটলারের উত্থান ঘটে গিয়েছে। রাইখস্ট্যাগের পতন ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু পুরো প্রশাসন নাৎসি নিয়ন্ত্রণে। রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে পা রাখার আগে তার চেহারা বুঝতে পারেননি। কিন্তু বুঝতে পেরেই তিনি ভিয়েনা ও বার্লিন শহরের সমস্ত বক্তৃতায় শান্তির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। বলা বাহুল্য, সেদিন জার্মানির অনেক মানুষই তাঁকে গ্রহণ করেননি। ১৯২১ সালে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা তিনি পেয়েছিলেন, সেটা আর ১৯২৬ সালে ছিল না। কিন্তু ওই গরিব ইহুদিরা আবারও অবাক হয়ে শুনেছিল তাদের ‘রাব্বি’-র কথা।
আরও পড়ুন
যুদ্ধক্ষেত্রেও হারায়নি মানবিকতা, আমেরিকার বোমারু বিমানকে ‘জীবনদান’ জার্মান পাইলটের
১৬ অক্টোবর শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য হঠাৎ করেই ফিরে আসতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তার আগেই ৪ অক্টোবর তারিখে কবির সামনেই জার্মান ভাষায় ‘ডাকঘর’ নাটকেরই অনুবাদ অভিনয় করে দেখায় জার্মানির মানুষ। কী অদ্ভুত সমাপতন, তাই না? সেদিনও নাৎসি উত্থানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল ওই একই নাটকে।
আরও পড়ুন
অনশন শুরু করলেন জেলবন্দি নজরুল, প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম রবীন্দ্রনাথের
সমাপতন কী এই দুবারই? না, আরও এক মুক্তির স্বপ্নের সাক্ষী ছিল এই একই নাটক। ১৯৪০ সালের ১৪ জুন ভোর ৫টায় যখন নাৎসি বাহিনী প্যারিস শহরে ঢুকে পড়ল, একদল নৃশংস হত্যাকারীর কবলে চলে গেল পৃথিবীর কলা জগতের রাজধানী; সেদিন শেষ মুহূর্তে প্যারি রেডিও স্টেশন থেকে সম্প্রচারিত হয়েছিল একটি শ্রুতিনাটক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’, ফরাসি অনুবাদে।
“অনেক পুরোনোকালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম – একটি লাল রঙের রাস্তা ধরে। …সেখানে পাহাড়ের গায়ে গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।” জানি না এই কথাগুলো জার্মান, ফরাসি বা পোলিস ভাষায় শুনতে কেমন লাগে। কিন্তু ছবিটা তো একই থেকে যায়। আর এই ছবিই বারবার মানুষকে প্রস্তুত করে আসন্ন ধ্বংসের বিরুদ্ধে। জন্ম দেয় অজস্র মৃত্যুঞ্জয়ের। যুদ্ধ নয়, মৃত্যু নয় – থেকে যায় একটা স্বপ্ন। এক অনিমিখ শান্তির জগত।
তথ্যসূত্রঃ Rabindranath Tagore and Germany, MARTIN KAMPCHEN
দিয়েত্রিচ ভন শলতিৎজ: প্যারিসের সত্যিকার নাকি স্বঘোষিত পরিত্রাতা?/ সোহম দাস, রোর বাংলা
Powered by Froala Editor