“বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর আর ভালো জিনিসগুলোকে চোখে দেখা যায় না, স্পর্শও করা যায় না। সেগুলো উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে।” কথাগুলো হয়তো অসাধারণ কিছু নয়, যে কোন সূক্ষ্ম রুচি বা অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই একথা বলতে পারেন। কিন্তু কথাগুলো যদি হয় হেলেন কেলারের, তাহলে বোধহয় আরও বেশি করে ভাবিয়ে তোলে।
পুরো নাম হেলেন অ্যাডামস কেলার। ১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় তাঁর জন্ম। বাবা আর্থার কেলার, মা কেট অ্যাডামস। হেলেন জন্ম নিয়েছিলেন আর পাঁচটি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও বাক-শ্রবণ ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুর মতই। কিন্তু বয়স যখন ১৯ মাস, এক গুরুতর ব্যাধি আক্রমণ করল সেই শিশুকে। বাবা-মা বহু চিকিৎসা, অনেক চেষ্টা করে মেয়ের জীবন ফিরিয়ে আনতে পারলেও তার কথা বলা, শোনা এবং দেখার ক্ষমতা হারিয়ে গেল। বিভিন্ন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁর মা-বাবা, কেউ তেমন আশা দিতে পারেননি। ছ’বছর বয়সে বাবা-মা হেলেনকে নিয়ে যান ওয়াশিংটনের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে— যাঁর নাম আমরা দূরভাষ আবিষ্কর্তা হিসেবেই মূলত জানি। গ্রাহাম বেল হেলেনকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন যে বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পাওয়া সম্ভব।
গ্রাহাম বেল-এর কথায় হেলেনের বাবা বোস্টনের পার্কিনস ইনস্টিটিউশনে হেলেনকে ভর্তি করে দেন। এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা ডাক্তার হো হেলেনকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেন। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের পর হেলেনের জীবনে আসেন তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ও শিক্ষয়িত্রী- অ্যান সুলিভ্যান। অ্যান দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই স্পর্শের মাধ্যমে জগৎ চেনাতে লাগলেন হেলেনকে। আলোর ছোঁয়া এবং অন্ধকারের অনুভূতির তফাৎ বোঝালেন। কল চালিয়ে হাতের ওপর বয়ে যাওয়া তরলকে চেনালেন ‘জল’ বলে। একে একে পরিচয় ঘটল বাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্র, টেবিল, চেয়ার, বিছানা ইত্যাদির সঙ্গে। আস্তে আস্তে হেলেন সুলিভ্যানের তত্ত্বাবধানে সব শিখে নিতে থাকেন। লুই ব্রেইল-আবিষ্কৃত ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে হেলেন লেখাপড়া শিখতে শুরু করেন। কয়েক বছরেই হেলেন ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রিক, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রেইল টাইপ রাইটারে লিখতে শেখেন। হেলেন ১১ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে, কঠোর অধ্যবসায় সহকারে কথা বলার চর্চা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর বাকশক্তি অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। কুড়ি বছর বয়সে হেলেন ভর্তি হন র্যা ডক্লিফ কলেজে। কলেজে পড়তে পড়তেই তিনি লেখেন তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘Optimism’। চার বছর পর তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্নাতক হলেন। ১৯২২ সালে ডাক্তার বেলের মৃত্যুর পর, তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হেলেন বেলের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। দৃষ্টিহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই হেলেন বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যেতেন, সঙ্গী হতেন তাঁর শিক্ষিকা ও সহযোগী অ্যান সুলিভ্যান।
১৯৩৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অ্যান সুলিভ্যান—প্রিয় সঙ্গীর এই চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না হেলেন, সাময়িক ভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন। তাদের শান্তি ও আশার বাণী শুনিয়ে জীবনে ফেরার কথা বলতেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক সচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ব্যক্তিগত জীবনে গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও, রাজনৈতিক ভাবনায় তিনি ছিলেন প্রগতিবাদী। সমর্থন করতেন আমেরিকান সোশ্যালিস্ট পার্টিকে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর মননের ছাপ রয়েছে ‘আউট অব দ্য ডার্ক’ (১৯১৩) বইটিতে। ১৯১২ সালে তিনি যুক্ত হন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে। বিশ্বশান্তির সমর্থক হেলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধেও বক্তব্য রেখেছিলেন। নারীদের ভোটাধিকার, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি নানা সামাজিক বিষয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন বরাবর।
আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি
১৯৫০ সালে হেলেনের পঞ্চাশ বছরের কর্মময় জীবনকে সম্মান জানাতে প্যারিসে এক বিরাট সংবর্ধনা সভা আয়োজিত হয়। ১৯৫৯ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে জাতিসংঘ। হেলেন কেলার নামটিই আজ যে কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন মানুষের কাছে আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রতিবন্ধকতায় পিছিয়ে যাওয়া অসহায় মানুষ নন, তাঁরা যে ‘বিশেষ ভাবে সক্ষম’--এই মহীয়সী নারীর রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত সে কথা বুঝিয়ে দেয়। শারীরিক সব অক্ষমতাকে অধ্যবসায় এবং মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করে হেলেন হয়ে উঠেছিলেন একজন চিন্তাশীল-সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব, সেই সঙ্গে এমন বহু ‘বিশেষ ভাবে সক্ষম’ মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা।
আরও পড়ুন
সুনীলকে যৌনমিলনের প্রস্তাব দিলেন গিন্সবার্গ, পালটা শর্ত সুনীলেরও
হেলেনের স্পর্শ অনুভূতি ছিল অসাধারণ। বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই তিনি বুঝতে পারতেন তাতে কী সুর বাজছে। সুরের বা শব্দতরঙ্গের সাথে এক আশ্চর্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর, শুনতে না পেলেও অনুভবে হয়ে উঠেছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের এক মরমী সমঝদার! দৃষ্টিশক্তিহীন শিশুদের জন্য বিভিন্ন স্থানে আবেদন করে, তহবিল সংগ্রহ করে, বক্তৃতা দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একাধিক সমিতি ও স্কুল। ‘হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি এখনো কাজ করে যাচ্ছে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য। ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি ওভারসিজ ব্লাইন্ড’ গঠিত হয় মূলত তাঁরই জীবন ও কর্মকে স্মরণে রেখে।
আরও পড়ুন
‘পাঁঠার বাংলা’ খেতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ, গিলে নিতেন কাঁচা ডিমও!
সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি সমাজের জন্য নানা গঠনমূলক কাজে জড়িয়ে ছিলেন আজীবন, সাহিত্যের আঙ্গিনাতেও রেখেছিলেন প্রতিভার স্বাক্ষর। ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ (১৯০৩), ‘লেট আস হ্যাভ ফেইথ’, ‘দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন’ (১৯০৮), ‘মাই রেলিজিয়ন’ (১৯২৭) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কে হেলেনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলে কবি তাঁর হাতের ওপর আঙুল চালিয়ে নিজের কবিতা ‘পাঠ’ করে শোনান—সে কোন কবিতা, আমরা জানি না। কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে করে না কি, কবি হয়তো তাঁকে শোনাতে চেয়েছিলেন “আর রেখোনা আঁধারে আমায় দেখতে দাও”, অথবা “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে...”!
তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন ল্যাংসটন হিউজের মতো কবি; আর এক বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন তাঁর লেখায় হেলেন কেলারকে উল্লেখ করেছিলেন ‘মিরাকল ওয়ার্কার’ বলে। এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৬২ সালে, তার নামও ছিল ‘দ্য মিরাকল ওয়ার্কার’। এই ছবিতে অ্যান সুলিভানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অ্যান বেনক্র্যাফট। আর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন পেটি ডিউক। ১৯৭৯-এ এই ছবিটি ‘রি-মেক’ করা হলে এই অভিনেত্রীই আবার রূপদান করেন হেলেনের শিক্ষয়িত্রী ও সহযোগী অ্যান সুলিভ্যান-এর চরিত্রে। আর ভারতে হেলেনের মতোই এক কাল্পনিক চরিত্রের জীবন অবলম্বনে নির্মিত বিখ্যাত ‘ব্ল্যাক’ চলচ্চিত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে রানি মুখার্জি আর অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়। সে অভিনয় যেন কথা বলে উঠেছে হেলেন কেলারের লেখা একটি কবিতার চিত্ররূপ হয়ে-
‘যা হতে পারত আমার দৃষ্টি, ওরা তা সরিয়ে নিল, কিন্তু আমি স্মরণ করি মিল্টনের স্বর্গ,
যা হতে পারত আমার শ্রুতি, ওরা তা কেড়ে নিল, তবু বেটোফেন এসে মোছালেন আমার চোখের জল।
যা হতে পারত আমার স্বর, ওরা ছিনিয়ে নিল, কিন্তু যখন ছোট ছিলাম ঈশ্বরের সাথে কত কথা কয়েছি,
তাই বিশ্বাস করি, আমার আত্মাকে কেড়ে নেবার অনুমতি তিনি তাদের দেবেন না।’
Powered by Froala Editor