১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। বাংলা মতে ২২ শ্রাবণ। দুপুর তখন ১২টা বেজে ১০ মিনিট। শহর কলকাতা তো বটেই, গোটা বিশ্ব একটা ঝড়ের অপেক্ষা করছে যেন। সমস্তটা শান্ত। ব্যস্ততা রয়েছে বটে, তারই মধ্যে উত্তর কলকাতার একটা অংশে নিভে এল প্রদীপ। ‘কে যায় অমৃতধাম যাত্রী’! যে মানুষটা নিজের জীবনে বারবার মৃত্যুকে দেখেছেন, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনের মাহাত্ম্য অনুভব করেছেন, দেখিয়েছেন আলোর সন্ধান; সেই মানুষটির নাড়ির স্পন্দন হঠাৎ আজ থমকে গেল। নিঃশ্বাস ফেলছেন না তিনি। শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে এল। মৃত্যু হল বাঙালির প্রাণপুরুষের। মৃত্যু হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক এক অতিমানবের…
শান্তিনিকেতন থেকে কবির না আসার কাহিনি একটা অন্য পর্ব। কিন্তু সেই ব্যথাটুকু মনে লেগেছিল। ১৯৪১-এর ২৫ জুলাইয়ের সেই শেষ যাওয়া কিছুতেই মানতে পারেননি গুরুদেব। তাঁর সাধের জায়গা, নিজের হাতে যাকে সাজিয়েছেন, কোথায় না গেছেন এর জন্য; তাঁকে ছেড়ে এমন বেলায় চলে যাবেন! কিন্তু তিনি তখন অশক্ত, বৃদ্ধ। মৃত্যুর পর হয়ত সেই কথাগুলোই মনে করছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারী। এবং এই শেষলগ্নে এসেই কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যার কোনো উত্তর পাননি কেউ। বা পেলেও, কখনও প্রকাশ করেননি…
ভারাক্রান্ত মনে যখন সবাই জোড়াসাঁকোয় বসে, তখন বারবার নির্মলকুমারীর কাছে লোক আসতে লাগল। প্রত্যেকবারই ইঙ্গিত ছিল একটিই, তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এদিকে রবি ঠাকুর তাঁর মৃত্যু পরবর্তী কিছু ইচ্ছের কথা তাঁকে বলে গেছেন। সেসব পালনের দায়িত্ব তাঁরই। তার মধ্যে এমন উৎপাত কেন? হঠাৎ ফোন এল গুপ্তনিবাস থেকে। সেখানেই তখন থাকতেন মহলানবিশরা। কী হল বাড়িতে? সব ঠিকঠাক? তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখেন, সমস্তটাই ঠিক; ফোনটি ভুয়ো। যখন জোড়াসাঁকো পৌঁছলেন, তখন দেখলেন লোকে লোকারণ্য। এমনটা কী করে হল?
এরপর ঘটল সেই মর্মান্তিক ঘটনা। নিয়ম অনুযায়ী রবি ঠাকুরের মরদেহকে যখন স্নান করানো হচ্ছে, তখন একদল লোক ঘরে ঢুকে পড়ল। তাঁদের কেউ কোনোরকম বাধাটুকুও দিল না? শেষে যখন রবি ঠাকুরকে সাজিয়ে শেষ সজ্জায় শায়িত করা হল, তখন বাড়ির লোকের সামনেই একদল লোক এসে কবির দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল! সামান্য শিষ্টাচারের বালাই নেই; বিশ্বকবির মর্যাদাটুকুও রাখল না এরা। বাইরে অহরহ শোনা যেতে লাগল ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়! জয় বিশ্বকবির জয়!’ সমস্তটাই জোড়াসাঁকোর ভেতরের মানুষদের কাছে সূচের মতো বিঁধছিল। সেই সঙ্গে সজনীকান্ত দাসের বয়ানও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহাসিকভাবে যেখানে দেখা গেছে কবিগুরুর শেষযাত্রায় বিশৃঙ্খলার কথা, সেখানে তিনি ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদকীয়তে সেই সমস্ত ঘটনা অস্বীকার করেছিলেন। এবং এও বলেছিলেন এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, ইচ্ছে করে রটানো হচ্ছে। এমন কথার কী প্রয়োজন, তা আজও জানা যায়নি।
শেষযাত্রার বর্ণনা এর আগেও অনেক জায়গায় করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শরীর মাটিস্পর্শ করেনি সেটা যেমন সত্য, তেমনই তাঁর মরদেহের ওপরও কম অত্যাচার হয়নি। কেউ চুল-দাড়ি ছিঁড়ে নিয়েছে। কেউ প্রণাম করার অছিলায় তুলে নিয়েছে পায়ের নখ। গোটা রাস্তা লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যে আসতে পারেননি রথীন্দ্রনাথও। না, বাবার মুখাগ্নি করতে পারেননি তিনি। এ-বিষয়ে রাণী চন্দ লিখেছিলেন – ‘রথীদা যাচ্ছেন। ‘মুখাগ্নি’ কথাটা উচ্চারণ করতে আর পারলেন না। বললেন, আমি যাচ্ছি—তুমিও চলো। ...একটা মোটরে, বাড়ির মোটরই হবে, রথীদার সঙ্গে আমরাও উঠলাম। ...ভিড়ের চাপে মোটর চলে না—আমরা নেমে পড়লাম। নিশ্ছিদ্র ভিড় নিমতলা ঘাটের পথে। রাম অধিকারী মশায় দু হাতে রথীদাকে আগলে ধরে ভিড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করতে লাগলেন।— রাম অধিকারী মশায়ের দেহে যেমন গলায়ও তেমনি জোর। তিনি চীৎকার করে ভিড়ের উদ্দেশে বলতে লাগলেন, আপনারা একটু পথ ছেড়ে দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পুত্র রথীন্দ্রনাথ এসেছেন পিতার কাজ করতে—আপনারা একটু পথ দিন। রাম অধিকারী যতই চেঁচাচ্ছেন ভিড় ততই চঞ্চল হয়ে উঠছে—কোথায় রবীন্দ্রনাথের পুত্র—তাঁকে দেখবে তারা। মুহূর্তে ভিড়ে যেন উত্তাল তরঙ্গ জাগল। আর উপায় নেই ঘাটে যাবার। রথীদা শোকে অসুখে কাহিল ছিলেন, এবারে যেন সম্বিৎ হারিয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হল।”
যে শোভাযাত্রা বিকেল তিনটের সময় শুরু হয়, সেখানে শেষকৃত্যের কাজ আরম্ভ হয় রাত আটটা নাগাদ। মুখাগ্নি করেন ঠাকুর বংশেরই পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে দাহ করা হয়, সেখানে আজ তাঁর স্মরণে রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। তাতে লেখা – ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার।’ কবির ইচ্ছা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর এই গান যেন গাওয়া হয়। নিমতলায় তাঁর সমাধিফলকেও লেখা রয়েছে এই পঙক্তিগুলি। কিন্তু সত্যিই কি ‘শান্তি’ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মরদেহ? উত্তরে পাক খায় দীর্ঘশ্বাস...
আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
তথ্যসূত্র-
১। বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ
২। শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮
৩। ১। গুরুদেব- রানী চন্দ
Powered by Froala Editor