রবীন্দ্রনাথের কোনো ‘রবীন্দ্রনাথ’ ছিল না, ভাগ্যিস!

বাঙালির মুশকিল হল তাঁর একটা রবীন্দ্রনাথ আছে। যে কারণটা সারাবিশ্বের কাছে গর্বের হওয়া উচিত, তা-ই যেন এখন গলার কাঁটা। এ বিলাপের ব্যাখ্যা নিশ্চিতভাবেই বহুমুখী। তার সবমুখ যে সকলে আমরা সঠিক অনুধাবন করে ফেলেছি এমনটাও নয়। তবে একথা সত্যি, বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে প্রায় কয়েকযুগ পর কোথায় রাখল এই নিয়ে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব খেলা করছে মনের ভেতর। রবীন্দ্রনাথ কোথায়? শোকেসের চোদ্দো খণ্ডের রচনাবলিতে? পাড়ায় পাড়ায় পঁচিশের বিচিত্রানুষ্ঠানে? ঠাকুরঘরের ধূপের ধোঁয়ায় হাঁফিয়ে ওঠা ফটোফ্রেমে? নাকি স্বরলিপি ভুল হলে কান মুলে দেওয়া কঠিন গানের ক্লাসে?

আজ যে রবীন্দ্রবিকৃতি নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা তাঁর উত্তর খুঁজতে গেলেই যে চলে আসছে উপরের প্রশ্নগুলো, হতেই পারে নিছক কল্পনাশ্রয়। তবু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের জটিলতা যে এক ভারী জগদ্দল হয়ে বসছে বহমানতায়, তা নিয়ে তো সংশয় নেই কারও। একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম গতবছর। সেখানে দেখেছিলাম আঠারো বছর থেকে তেইশ বছর অবধি ছেলেমেয়েদের শতকরা তেষট্টিভাগ রবীন্দ্রনাথের গান ধারাবাহিকভাবে শোনেন না। তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান পৌঁছয় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাছবিতে কালেভদ্রে ব্যবহার হলে কিংবা কোনো চলচ্চিত্র তারকার গলায় কোনো গান ভেসে এলে। খুব সহজেই ইউটিউব ট্রেন্ড দেখে এ সমীক্ষার জাস্টিফিকেশন দিয়ে দেওয়া যায়। তবে একথাও ঠিক যে তাঁরা গান পছন্দ করছেন না এমনটা নয়, কিন্তু খামতি কোথায়?

একটা প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অন্তর্ভেদ করবেন তাঁর দায় অনেকখানি বর্তায় তাঁদের আগের প্রজন্মের ওপর। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই যে একটা প্রজন্ম কদিন আগেই রবীন্দ্র বিকৃতিকে সানন্দে গ্রহণ করে নিল, তার দায় কার? বিকৃতি যিনি করছেন তাঁর একার? নাকি রবীন্দ্রনাথকে যে প্রজন্ম তাঁর উত্তরপ্রজন্মের কাছে পৌঁছেই দিতে পারেননি তাঁদেরও? তবে কি আমরা উদযাপনে খামতি রেখেছিলাম? না!
বরং এই উদযাপনের সময়োপযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়লাম। রবিপূজার চল সেকাল-একাল এবং আজন্মকাল-সবসময়ই এক থাকবে, সে আমাদের পরমধন কিন্তু এই উদযাপনের অছিলাকে পরিসর দেওয়ার মুন্সিয়ানায় আমরা হেরে গেলাম হয়তো। আমরা ভেবে দেখিনি যে পাড়ায় পাড়ায় বিচিত্রানুষ্ঠানের মাঝে পিছনের সারিগুলো ফাঁকা হয়ে গেছিল ক্রমশ, আমরা বুঝিনি কড়া স্বরলিপির কচকচানি কোথায় গিয়ে এক শিশুমননে তৈরিই হতে দিল না সেই 'কান্নাধারার দোলা'!

পূজার ছলে ভুলে গেলাম আস্ত রবীন্দ্রনাথকে, সেই কবেই তো তিনি বলে গেছেন- "তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি…"

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ, রবিঠাকুর বুঝতে পারছেন তাঁর সময় হয়ে এল, শান্তিনিকেতনে বসে তিনি সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে লিখছেন -
"আজ আমার বয়স আশি বছর পূর্ণ হল,আমার জীবনক্ষেত্রের বিস্তীর্ণতা আজ আমার সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বতম দিগন্তে আমার যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপরপ্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে…"
এই রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে দেখার সাধ্যি কই আমাদের? এক মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির মতো যিনি নিজের ফেলে আসা জীবনকে দেখছেন আকাশের সূর্যের অবস্থান দিয়ে, এই সৌন্দর্যের জন্য তো কোনো ব্যাকরণ বই লিখতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। এ-প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে দেবব্রত বিশ্বাস রেকর্ড করলেন -

"এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে…"
সেই ঐতিহাসিক রেকর্ডিং বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড রেকর্ড অনুমোদন দিতে নারাজ। কারণ গানের "চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে"- লাইনটিতে 'চন' শব্দটি নাকি স্বরলিপি অনুযায়ী হয়নি। পরবর্তীকালে শান্তিদেব ঘোষ এ-গানের রেকর্ডিং অনুমোদন দিলেও কয়েকবছর পরেই আবার কোপ পড়ল তাঁর ওপর৷ 'পুস্প দিয়ে মারো' আর 'তোমার শেষের গানের' রেকর্ডিং ফের রদ করে দিল বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড এর কারণ হসেবে চিঠিতে লেখা হল-
" Excessive music accompaniment hampers the sentiment of the song "
" The tempo of the song is too quick "
দেবব্রত বিশ্বাস দুঃখে বলেছিলেন আর জীবনে রবিঠাকুরের গান রেকর্ড করবেন না। কপিরাইট অধ্যায় অতীত এখন, তবু আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথকে শোকেসে তুলে রাখার প্রবণতা অনেকাংশে এক রয়ে গেল আমাদের মধ্যে। মনঃস্তত্ত্ব বলে, নিয়ম যত কঠোর হয় নিয়ম ভাঙার প্রবণতা তত বেশি জন্মায় শিশুমনে। কোথাও গিয়ে স্ববিরোধিতা হলেও আমরাই হয়ত অলক্ষে বীজ বপন করেছি রবীন্দ্রবিকৃতির।

আত্মপরিচয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-
"অহংটাই পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলিয়া দাবী করিতে কুণ্ঠিত হয় না। এই জন্যেই তো দুর্বৃত্তটাকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য এত অনুশাসন। এই জন্যেই তো মনু বলিয়াছেন- সম্মানকে বিষের মতো জানিবে, অপমানই অমৃত। সম্মান যেখানেই লোভনীয় সেখানেই সাধ্যমতো তাহার সংস্রব পরিহার করা ভালো…"
এই রবীন্দ্রনাথ কই? কোথায় এই দর্শন? রচনাবলীর চতুর্দশ খণ্ডের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায়? নাকি উদযাপনের মাল্যের ভিড়ে হারিয়েই গেছেন এই প্রাবন্ধিক? একজন শিশুকে আমরা রবিশিক্ষার পাঠ শুরু করাই সহজপাঠ দিয়ে, সেই সহজপাঠের পাতা শেষ করে সে নিয়ে গেল কতটুকু রসদ? তার খেয়াল রাখতে পারছি কি আমরা? অভ্যাসে গেয়ে ওঠা 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমারা চরণ ধূলার তলে' প্রার্থনা সংগীতের আদৌ কতটুকু সঞ্চারী তাঁর জীবনসায়াহ্নে তাঁকে দিয়ে বলাতে পারবে -

‘নিজেরে করিতে গৌরবদান, নিজেরে কেবলি করি অপমান'? রবীন্দ্রনাথের এই বহমানতার অন্তরায়ের প্রাচীর হয়ত অজান্তেই গেঁথে গেল আমাদের মাঝে। সোশ্যাল স্ট্যাটাস মেনটেন করতে রবীন্দ্রনাথ জানতেই হয় আজকাল, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজোড়া ফাঁদে ধরা না দিয়ে নিজেদের ফাঁদেই জড়িয়ে যাচ্ছি আমরা। সমাজ, রাজনীতি আর জীবনের ত্রিভূজে রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন না বহুকাল।

"সকল মানুষেরই মনে ‘আমার ধর্ম’ বলে একটি বিশেষ জিনিস আছে। কিন্তু সেইটিকেই সে স্পষ্ট করে জানে না। সে জানে আমি খৃষ্টান, আমি মুসলমান, আমি বৈষ্ণব, আমি শাক্ত ইত্যাদি… নিজের ভেতরকার ধর্মটা তাঁর নিজের চোখেও পড়ে না”- জীবন সায়াহ্নে একথা অবলীলায় লিখছেন রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথ। একেবারে সুগাঢ় রাজনৈতিক চেতনার দরজা খুলে দিচ্ছেন। সে দরজা আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি একটু একটু করে, কারণ রবীন্দ্রনাথ তো ঠাকুর, তাই তিনি রাজনৈতিক হতেই পারেন না। এও এক শঠতা যা রবীন্দ্র অবক্ষয়ের বৃহৎ কারণ বলেই মনে হয়।

আমাদের নিত্য জীবনে কোত্থাও রবীন্দ্রনাথ নেই শুধু উদযাপনে আছেন। বাঙালির জীর্ণ অন্তর্বাস ঢাকার জন্য পশমিনা কাপড় হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ, অনাথের নাথ হতে না পেরে তিনি অলক্ষ্যেই কাঁদছেন হয়তো। সাম্প্রদায়িক শক্তি হয়তো মুছে ফেলতে পারবে না রবীন্দ্রনাথকে। এত দিনের চেষ্টায় বাঙালিও পারেনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জোরেই উজ্জ্বল। তাঁর সৃষ্টি ও বিনাশ দুই-ই তিনি নিজেই করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু উন্নাসিক বাঙালির রবীন্দ্রনাথ প্রতিটা পঁচিশে বৈশাখ আরও একবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, কল্লোলিনী কলকাতা তথা বাঙালির আর নিজে চলার ক্ষমতা নেই - রবি আভরণে অনেকটা ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’!

শুধু রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে কোথায় যেতেন? তাঁর তো আর রবীন্দ্রনাথ নেই। একটিবার হয়তো সেদিন ডি এল রায়কে যেমন প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন, আজ আমাদের প্রশ্ন করতেন - তোমার গায়ক গান গাইতে তো জানে, থামতে জানে তো?

আমরা তার উত্তর খুঁজতে কোন স্বরলিপির কাছে ফিরতাম? কোন সিংহাসনের সামনে বসতাম? কোন ছবির সামনে মাথা নতজানু হতাম?

এই পঁচিশের পড়ন্ত রোদে বাঙালির মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালে সে জাতি বড় অসহায় হয়ে যাবে যে!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)