রবিবারের এক অলস দুপুর। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের স্কুলে বসে আছে একটি কিশোর। সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছে সে। হঠাৎই বিছানার ওপর রাখা একটি বইয়ের দিকে চোখে পড়ল ওর। রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’। পাতা ওলটাতেই একটা লেখায় চোখ আটকে গেল। “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”— লাইনগুলো কিরকম কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর! এ কী হল তার!
ছেলেটা বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কবিতাটা। সেই সঙ্গে খেলা করছে একটি সুর। গণেশ পার্কের নিরালায় বসে পুরো সুরটা করেও নিল। আর পারছে না সামলাতে। কাছেই লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্রের নাট্যদলের ঘর। সটান ঢুকে পড়ে সুর বাজাতে লাগল। হঠাৎই লক্ষ্মীদা’র আওয়াজে চমক ভাঙল। “সুরটা মোটামুটি ঠিক আছে, একটা দুটো জায়গা বাদ দিয়ে।” উনি কী করে জানলেন তাঁর সুরের কথা? পরে লক্ষ্মীদা’ই ধরিয়ে দিলেন ‘সত্যি’টা। সুরটা তো রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সেই সুরেই তো গাইল ও। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল তরুণ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের। এ কী বলছেন! তার আর রবি ঠাকুরের সুর একই জায়গায় এসে মিলেছে! অথচ সে তো আগে এই গান শোনেনি…
সেই তখন থেকেই পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের। বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীত জগতের প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটির কাছে সঙ্গীত ছিল একটা সমুদ্রের মতো। যেখানে সারাটা জীবন ভেসে বেরিয়েছেন তিনি। সেখানেই মাঝি হিসেবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সুরে সুরে তো আলাপ হয়েছিল আগেই, মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় কলেজে পড়ার সময়ই। কিন্তু সেই আলাপ খুব একটা সুখের ছিল না।
‘শেষ খেয়া’ কবিতাটি পড়ার পর নিজেই সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। সব জায়গায় গাইতেও লাগলেন সেই গান। অবশেষে বিপদ এল। জোড়াসাঁকো থেকে পঙ্কজকে ডেকে পাঠালেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। কবিকে না জিজ্ঞেস করেই তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে দিয়েছেন, বুঝতে পারলেন তিনিও। সে যাত্রা ‘বন্ধু’র ওপর দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে গেলেন। কিন্তু মাসখানেক পরে আবারও ডাক এল। এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের থেকে! রীতিমত কালঘাম ছুটে গিয়েছিল পঙ্কজ মল্লিকের। কোনোরকমে গুরুদেবের সামনে গানটি গাইলেন। তারপর রথীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে দে দৌড়!
আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ
পরে অবশ্য এই সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল। রবীন্দ্র সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধক এই ছেলেটিকে বিশেষ পছন্দও করতেন রবীন্দ্রনাথ। আমৃত্যু সেই যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল। তাঁর গানের ওপর এতটাই বিশ্বাস ছিল যে, পঙ্কজ মল্লিককে রবি ঠাকুর বলেছিলেন। “আমার বাকি লেখা যেগুলি রইল, যার আমি সুর করে উঠতে পারলুম না, তুমি তার সুর দিয়ো”। এতটাই বিশ্বাস, মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা ছিল পরস্পরের।
আরও পড়ুন
হেমন্তের গানে রাগ ভুললেন পঙ্কজ মল্লিক, সজল হয়ে উঠল দুটি চোখ
একটা সময় বাংলা ও হিন্দি সিনেমার জগতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। পঙ্কজ মল্লিক তখন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। সেটা শুধু সিনেমাতে নয়, রেডিওর জগতেও বটে। এরও শুরু করেছিলেন রবি ঠাকুরের হাতটি ধরেই। মধ্যবিত্ত অভাবী পরিবারের ছেলে পঙ্কজকে কলেজে পড়াকালীনই চাকরির খোঁজে বেরোতে হয়। একদিন কাজ সারার পর বাড়ি ফেরার সময় প্রবল বৃষ্টি। যেন থামতেই চায় না! ভিড়ের মধ্যে এক ডাক্তারখানার ডিসপেনসারির রোয়াকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। একে বৃষ্টি, তার ওপর ক্লান্ত; কখন যে গলায় গান উঠে এল! পঙ্কজ মল্লিক গাইতে লাগলেন, “এমন দিনে তারে বলা যায়”…
আরও পড়ুন
সরে গেলেন পঙ্কজ মল্লিক, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সঙ্গীত পরিচালনায় ২৪ বছরের যুবক হেমন্ত
হঠাই পেছনে কে যেন টোকা মারল। ফিরে দেখেন, স্যুট পরা একজন ভদ্রলোক। নাম জানালেন, ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। ঘরের ভেতর বসতে বলে একটি অন্যায় আবদার করে বসলেন। ‘যে গানটি একটু আগে গাইছিলেন, সেটা আরেকবার শোনাবেন?’ একটু অস্বস্তি হলেও, গান ধরলেন পঙ্কজ। তন্ময় হয়ে গেলেন দুজনেই। শেষ হওয়ার পর ডাঃ আয়েঙ্গার জানালেন- ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু ব্রডকাস্ট অন রেডিও?’ ওঁর নাকি চেনাশোনা আছে, হয়ে যাবে।
আকাশ থেকে পড়লেন পঙ্কজ মল্লিক। কোথাকার কে বলছে কলকাতার রেডিওতে গান গাওয়াবে! কিন্তু ঠিক সপ্তাহ দুয়েক পরেই বাড়ির সামনে হাজির হলেন ডাঃ আয়েঙ্গার। পঙ্কজ মল্লিককে নিয়ে সোজা টেম্পল চেম্বারসের অফিসে। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার শুনলেন তরুণ পঙ্কজের গান। রবীন্দ্রসঙ্গীতই শোনালেন। সেইদিনই ব্রডকাস্ট করা হল তাঁর গান। দিনটা ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭ সাল। কলকাতার বেতারে প্রথমবার সম্প্রচারিত হল রবীন্দ্রসঙ্গীত। জন্ম হল পঙ্কজ মল্লিকের। সেই শুরু হল ইতিহাসের সঙ্গে পথ চলা…
কে এল সায়গলেরও রবীন্দ্র-প্রীতির শুরু বন্ধু পঙ্কজ মল্লিকের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথ, রেডিও, সিনেমা, সঙ্গীত শিক্ষার আসর— এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে শেষে যোগ হল আরও একটি জিনিস। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাঙালির মহালয়া এবং পুজো যেটা না হলে শুরু হয় না। ১৯৩৪ সালের মহাষষ্ঠীর দিন প্রথম প্রচারিত হয় এটি। পরে অবশ্য মহালয়ার ভোরেই বেজে ওঠে আলোর বেণু। আর এই পুরো অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। তাঁর সুর করা গানগুলো আজও অমর হয়ে আছে।
দুঃখ কি ছিল না তাঁর? অভাবের পরিস্থিতিতে বড় হয়েছেন। গান করতে গিয়ে বাড়িতে সমস্যার সৃষ্টিও হয়েছে। যে রেডিওতে, সিনেমায় তিনি একের পর এক যুগান্তকারী কাজ করেছেন, সেখানেও জুটেছে অপমান। দিনের শেষে, সমস্ত কিছুর প্রত্যুত্তর ছিল গান। সেখানেই সারাজীবন ডুবে ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। ভারতীয় সিনেমায় প্রথম ‘প্লেব্যাক’ মিউজিকের সাক্ষী থেকেছেন যে মানুষটি, আজ কি ততটা মনে রেখেছি আমরা? সম্মান দিতে পেরেছি? একপ্রকার বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন তিনি। ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, বসন্তের আগেই সেই ক্ষত নিয়েই চলে গেলেন গানপাগল মানুষটি।
ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৫, ‘দিনের শেষে’
২) এখন খবর, যুগস্রষ্টা
Powered by Froala Editor