প্যারাডক্স! হয়তো তা বলাই সঙ্গত। যে-নোবেল নিয়ে রবি ঠাকুরকে আজীবন কাঁটার আঘাত সইতে হয়েছে, সেই পুরস্কার কবিকে আনতেও যেতে হয়নি। বলা যায়, তা নিজেই এসেছিল কলকাতায়, উঠেছিল কবির হাতে।
সম্প্রতি কলকাতার মুকুটে এসেছে নতুন পালক। মোট ছ-জন নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে এখন মিশে আছে কল্লোলিনীর নাম। তবে আজ, ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে আমরা বড়োজোর কল্পনা করতে পারি ১৯১৩-এর সেই দিনকাল (১৫ নভেম্বর)। জানা যায়, নোবেলপ্রাপ্তির খবর প্রথম আসে জোড়াসাঁকোতে। কবি সে-সময় বোলপুরে। যে-দিন সন্ধেয় সারা শহর জানল এ-কথা, পরদিন সকালে কবির জামাতা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও আরও কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ কবিকে টেলিগ্রাম করে সে-খবর জানান। কবি সে-সময় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমের কাছাকাছিই বেড়াচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন নেপালচন্দ্র রায়। টেলিগ্রাম হাতে পেয়ে বার তিনেক পড়ার পর কবি নেপালবাবুর হাতে তা তুলে দিয়ে বলেন, ‘নিন আপনার নর্দমা তৈরির টাকা।’ আশ্রমে সে-সময় একটা নর্দমা অর্ধেক তৈরি অবস্থায় পড়ে ছিল, টাকার অভাবে। কবি ও নেপালবাবু তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাতেই ছিলেন। নোবেলপ্রাপ্তিতে যেন সেই চিন্তা ঘুচল।
আরও পড়ুন
অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে নোবেল তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের আবদুস সালাম
অবশ্য এই টাকা ও সোনার মেডেল ইত্যাদি কবি সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে গিয়ে নিয়ে আসেননি বা নিতে যাননি। সে-অনুষ্ঠানটি হয়, ওই বছরেরই ১০ ডিসেম্বর। কবি তাই নিজে এই অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। তাঁর হয়ে স্টকহোমে এই খেতাব গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রদূত মিঃ ক্লাইভ। কবি ধন্যবাদ জানিয়ে যা লিখে দিয়েছিলেন তা পাঠ করেন তিনি – 'I beg to convey to the Swedish Academy my grateful appreciation of the breadth of understanding which has brought the distant near, and has made a stranger a brother.' পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতার গভর্নর হাউসে এক অনুষ্ঠানে তদানীন্তন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল কবির হাতে মেডেল ও অর্থমূল্য তুলে দেন।
নোবেল-প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছেও একটি বড়ো ঘটনা। কিন্তু এই নোবেল নিয়ে যে অহেতুক জটিলতা চলছিল তা কবিকে স্পষ্টতই ব্যথিত করেছিল। কারও কারও মত ছিল, ইয়েটসের কারণেই কবির নোবেলপ্রাপ্তি। অপর মহলের দাবি, সুইডেনের রাজ পরিবারের সুনজরের কারণেই এহেন লক্ষ্মীলাভ। আবার কেউ কেউ বলেন, সাহিত্যকীর্তি নয়, পশ্চিম মুলুকের কাছে এপারের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কারণেই তাঁর জনপ্রিয়তা এবং সেই হেতু নোবেল লাভ। কূটতর্ক আজও যে কম চলছে তা নয়। দেশের মধ্যেও সেদিন সমালোচনা ছিল বেশ জোরদারই। যদিও পাশাপাশি উচ্ছ্বাস ছিল বাঁধভাঙা। কিন্তু এ-সবের মধ্যে কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ? নোবেলের প্রাপ্তি সংবাদ পাওয়ার দিন তিনেক পর লিখতে বসা চিঠিকে রদেনস্টাইনকে লিখেছিলেন, যেন কুকুরের ল্যাজে টিন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এবার একটা প্রবল গোলযোগ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া আর-কোনো উপায় নেই।
আরও পড়ুন
নোবেলের কাছাকাছি গিয়েও ফিরতে হয়েছিল যে ১৪ জন বাঙালিকে
কবির বিরক্তি, ক্ষোভ স্পষ্টই টের পাওয়া যায় যখন তিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিভাষণে বলেন, এই বৈদেশিক বন্যায় নৌকা ভাসিয়ে যাঁরা তাঁকে সম্মান জানাতে এসেছেন তা তিনি বাস্তব বলে মনে করছেন না। কারণ এই বন্যা কেটে গেলেই পড়ে থাকবে ভাঙাচোরা আবর্জনার অবশিষ্ট। বরং দেশের মানুষের কাছ থেকে যে-নিন্দা তিনি পেয়েছেন তাই সত্যি বলে গ্রহণ করেছেন। ফলে সংবর্ধনার এই ফেনিল মদিরা তিনি ওষ্ঠে ঠেকালেন ঠিকই, কিন্তু অন্তরে গ্রহণ করতে পারছেন না। কবির এহেন ভাষণে সেদিন অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে প্রায় সাতশো লোক গিয়েছিলেন বোলপুরে। তাঁদের অনেকেই ব্যথিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। এই এত কাণ্ড ঘটেছিল ৭ অগ্রহায়ণ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, সেদিনটা ছিল কবির স্ত্রী ও ছোটো ছেলের মৃত্যুদিন। ফলে কবি তাঁর স্বভাবোচিত শান্তভঙ্গি খানিকটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর দিন সাত-আট পর, অর্থাৎ ১৫ অগ্রহায়ণ (১ ডিসেম্বর), শান্তিনিকেতনে বসেই কবি লিখলেন, আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে। এ-গানেই লিখলেন, ‘আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,/যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।/আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে,/ ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে।’ ঠিক একদিন আগে আঁধার রাতে লুকিয়ে আসা এই বন্ধুর উদ্দেশেই বুঝি লিখেছিলেন, ‘তুমি সংকট তুমিই ক্ষতি/ তুমি আমার আনন্দ।’
এইটেই রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ। তাই নোবেল প্রাপ্তি-সংবাদ তাঁর কাছে নর্দমা তৈরির টাকা হয়ে ওঠে অনায়াসে। যাই হোক, তাও নিয়ম অনুযায়ী নোবেল ভাষণ দিতে হয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ১৯২১ সালে কবি শেষমেশ স্টকহোমে গিয়ে পৌছান,- ‘ ... দেখেন স্টেশনে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যগণ তাঁকে স্বাগত করবার জন্য উপস্থিত; আর বাইরে বিরাট জনতা। সুইসরা যে ভারতীয় কবিকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে সম্মানিত করেছিল তিনিই আজ তাঁদের মধ্যে উপস্থিত, তারই আনন্দ প্রকাশ করবার জন্য সমস্ত নগর যেন ভেঙে পড়েছে।’
এখানে এক বিরল সম্মান পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির নোবেল ভাষণ শুনে অভিভূত হন ‘উপসালা খৃষ্টমন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা আর্চবিশপ’। কবিকে ক্যাথিড্রালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেও তিনি বক্তৃতা করেন। আর্চবিশপের উপস্থিতিতে চার্চের ভিতরে কেউ উপদেশ দেওয়ার অধিকারী ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ সেই বিরল সম্মান পান। প্রসঙ্গত, তিনি-ই প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ, যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন।