শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার

“১লা বৈশাখ ১৩২০। সেইদিনটি আমার এখনো মনে আছে। সন্ধ্যেবেলা আমরা স'কলে বসবার ঘরে বসে আছি। …এমন সময় জ্যাঠামশাই হাসতে হাসতে ওপরে উঠে এলেন। হাতে তাঁর 'সন্দেশে'র প্রথম সংখ্যা। কি চমৎকার তার মলাট! গলা-ভরা সন্দেশ হাতে সন্দেশ ভাই-বোন শোভা পাচ্ছে। যতদূর মনে হয় এইটেই ছিল প্রথম মলাট।"

১৯২৩ সালে লীলা মজুমদার প্রথম 'সন্দেশে'র জন্য গল্প লেখেন বড়দা সুকুমার রায়ের কথায়। গল্পটির নাম ছিল 'লক্ষ্মী ছেলে'।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই প্রমোদারঞ্জন রায় ও সুরমা রায়ের মেজ মেয়ে লীলা। ছোটবেলার এগারোটি বছর কাটে শিলং-এ। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে লীলারা এসে ওঠেন কিছুদিনের জন্য। আর সেই বছরের ১লা বৈশাখেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ।

১৯১৯ সালে পাকাপাকি ভাবে লীলা ও তাঁর পরিবার চলে এলেন কলকাতায়। উঠলেন উপেন্দ্রকিশোরের সেই বিখ্যাত ১০০ নং গড়পাড় রোডের বাড়িতে। ভর্তি হলেন সেন্ট জন্স ডায়েসেশন স্কুলে। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলেন তিনি। তবে তাঁর একটি রিপোর্ট কার্ড থেকে জানা যায়, বাংলায় তিনি অন্যান্য বিষয়ের থেকে কম নম্বর পেতেন।

সুকুমার রায় মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই ‘সন্দেশ’ বন্ধ হয়ে যায়। লীলা যখন বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় খবর আসে আবার ‘সন্দেশ’ শুরু হবে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের সন্দেশে তিনি লিখেছেন তাঁর 'দিনদুপুরে' গল্পটি। গল্পের সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনও নিজেরই।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে গোল্ড মেডেল নিয়ে এমএ। তারপর চলে গেলেন স্কুল শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে দার্জিলিং। দার্জিলিং-এই লীলার সঙ্গে সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথের। তিনি লীলাকে শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগে শিক্ষকতা করার প্রস্তাব দেন। শুনে লীলার আনন্দ আর দেখে কে! তখনই স্কুলে ইস্তফা দিয়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জন্মদিনে মঞ্চস্থ হয় 'নটীর পূজা'। তাতে অভিনয়ও করেন লীলা। রবীন্দ্রনাথকে একবার রান্না করেও খাইয়েছিলেন। এই সময়ের সব গল্প নিয়েই পরে লীলা 'এক বছরের গল্প' বইটি লেখেন।

১৯৩৯ সালে রামধনু কার্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় লীলা মজুমদারের প্রথম বই ‘বদ্যিনাথের বাড়ি’। এই বইটির ভূমিকা লিখবার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথের। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৪ সালে রঙমশাল পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ‘পদি পিসির বর্মি বাক্স’।

১৯৬১ সালে ভাইপো সত্যজিৎ রায় ও তাঁর বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নতুন করে সন্দেশকে ফিরিয়ে আনলেন। যথারীতি লীলার আবার ডাক পড়ল লেখার জন্য। প্রথম সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকল ‘টংলিং’। ১৯৬৩ সাল থেকে সত্যজিতের সঙ্গে সন্দেশের সম্পাদনার দায়িত্ব নেন লীলা। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন নলিনী দাসও। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই সম্পাদনা দায়িত্ব সামলে গেছেন লীলা।

এরপরের গল্প তো সবাই কম বেশি জানেন। তাঁর একেরপর এক সাহিত্য সৃষ্টির সাক্ষী হয়ে থেকেছে আপামর বাঙালি। এমন অনেক বাঙালি আছেন, যাঁরা শুধু ওঁর লেখা পড়ার জন্যই সন্দেশ নিয়মিত সংগ্রহ করতেন। সেই সব গল্প অন্য কোনোদিন…

ঋণ- পেরিস্তান
সম্পাদনা- সৌম্যকান্তি দত্ত ও সৌরদীপ বন্দোপাধ্যায়।

Powered by Froala Editor

Latest News See More