নিতান্ত ছেলেবেলাতেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ-চর্চা

সূর্যস্নান।। পর্ব ৩।।

ভারতের অজস্র বালক-বালিকার মতন, রবীন্দ্রনাথও আশৈশব রামকাহিনির প্রতি আকৃষ্ট। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনে রামায়ণের প্রভাব অপার, অবিস্মরণীয়। নিতান্ত বালককাল থেকেই তার আরম্ভ।

'জীবনস্মৃতি' বইতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন শিশুবয়সে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠের স্মৃতিকথা। দিদিমার "মার্বেলকাগজ-মণ্ডিত কোণছেঁড়া-মলাটওয়ালা মলিন বইখানি" কোলে নিয়ে মায়ের ঘরের দরজার কাছে বসে পড়তে আরম্ভ করেছিলেন রবি। সামনে অন্তঃপুরের আঙিনা ঘিরে চৌকোণা বারান্দা; সেই বারান্দায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে এসে পড়েছিল অপরাহ্নের ম্লান আলো। রামায়ণের কোনও একটা করুণ বর্ণনায় কবির চোখ দিয়ে জল গড়াতে আরম্ভ করেছে দেখে, দিদিমা জোর করে শিশুর হাত থেকে বইটি কেড়ে নিলেন।

এই হল সূত্রপাত। রামায়ণ-পাঠে নিতান্ত শৈশবেই যাঁর স্পর্শকাতর মন অশ্রুতে ভিজে গেল, তিনিই তো লিখবেন আদিকবি বাল্মীকির প্রতি সরস্বতীর এই আশীর্বাণী-

"অধীর হইয়া সিন্ধু কাঁদিবে চরণতলে,
চারি দিকে দিক্‌বধূ আকুল নয়নজলে।
মাথার উপরে তোর কাঁদিবে সহস্র তারা,
অশনি গলিয়া গিয়া হইবে অশ্রুর ধারা।
যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয়,
শতস্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগতময়।"

'বাল্মীকিপ্রতিভা'-র নায়কের ভূমিকায় নামবেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মনলোকে তিনি আদিকবির সঙ্গে একাত্ম হবেন। এই শিশুকালেই তার শুভারম্ভ। 

'জীবনস্মৃতি'-তে শৈশবের রামায়ণ-চর্চা নিয়ে আরও বেশ কিছু বিবরণ দিয়েছেন কবি। বলেছেন, শ্যাম নামক এক চাকর শিশুকালে তাঁকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে চারদিকে খড়ি দিয়ে গণ্ডি কেটে দিত। গম্ভীর মুখ করে তর্জনী তুলে সে বলত, গণ্ডির বাইরে গেলেই বিষম বিপদ ঘটবে। কবি সকৌতুকে স্মৃতিচারণ করছেন, "বিপদটা আধিভৌতিক কি আধিদৈবিক তাহা স্পষ্ট করিয়া বুঝিতাম না, কিন্তু মনে বড়ো একটা আশঙ্কা হইত। গণ্ডি পার হইয়া সীতার কী সর্বনাশ হইয়াছিল তাহা রামায়ণে পড়িয়াছিলাম, এইজন্য গণ্ডিটাকে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মতো উড়াইয়া দিতে পারিতাম না।" 

সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরবাড়ির বালক-মহলে রেড়ির তেলের ভাঙা সেজবাতি জ্বালিয়ে রামায়ণ-মহাভারত পাঠের আসর বসাত গৃহভৃত্য ঈশ্বর। চাকরদের মধ্যে থেকে আরো কয়েকজন শ্রোতা এসে হাজির হত। বালকের দল স্থির হয়ে বসে গোগ্রাসে গিলতেন রামায়ণী কথা। 

কবি বলছেন, "যেদিন কুশলবের কথা আসিল, বীর বালকেরা তাহাদের বাপখুড়াকে একেবারে মাটি করিয়া দিতে প্রবৃত্ত হইল, সেদিনকার সন্ধ্যাবেলাকার সেই অস্পষ্ট আলোকের সভা নিস্তব্ধ ঔৎসুক্যের নিবিড়তায় যে কিরূপ পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা এখনো মনে পড়ে।" এমন সময়ে আসরে এলেন কবির পিতার অনুচর কিশোরী চাটুজ্যে। দাশুরায়ের পাঁচালি গেয়ে অতি দ্রুত গতিতে কাহিনির বাকি অংশটুকু সম্পূর্ণ করলেন কিশোরী। কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় অবলুপ্ত হল- অনুপ্রাসের ঝক্‌মকি ও ঝংকারে বালকের দল একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। 

এমন সব মনোরম সন্ধ্যার স্মৃতি ধরা আছে 'বালক' কবিতায়। কবি বলছেন, 

"কিশোরী চাটুজ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে,
বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে
দ্রুতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,
থাকত আমার খাতা লেখা, প'ড়ে থাকত পড়া;
মনে মনে ইচ্ছে হত যদিই কোনো ছলে
ভরতি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে,
ভাবনা মাথায় চাপত নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে,
গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে।"

কিছুদিন পরে, বাল্মীকির মূল রামায়ণের সঙ্গে বালকের পরিচয় ঘটল। লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়ে জীবন কাটায়, আর কবি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়ে এসেছেন, এই দুর্দান্ত খবর দিয়ে মাকে একেবারে আশ্চর্য করে দিলেন রবি।

কবিজননী খুশি হয়ে বললেন, "আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।" 'ঋজুপাঠ' বইতে উদ্ধৃত রামায়ণের অংশটুকু স্মৃতি থেকে পড়ে গেলেন কবি, তবে মূল শ্লোক ও কবিকৃত ব্যাখ্যার মধ্যে খুব যে সামঞ্জস্য রইল তা নয়। চমৎকৃত সারদা দেবী অত বুঝলেন না, পুত্রগর্বে গর্বিত হয়ে রবির বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথকে ডেকে আনলেন ভাইয়ের মুখে রামায়ণ শোনার জন্য। বড়োদাদা একে মহাপণ্ডিত, দুয়ে কবি, তাঁর সামনে চালাকি ন চলিষ্যতি- রবীন্দ্রনাথ বেশ ফাঁপরে পড়লেন! তবে রক্ষা এই যে, ভাইয়ের মুখে গোটাকয়েক শ্লোক শুনেই প্রশংসাপূর্বক স্থানত্যাগ করলেন সদাব্যস্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ, বাংলা ব্যাখ্যা শুনিয়ে রবিকে অপদস্থ হতে হল না! 

বাল্মীকি রামায়ণের চরিত্রদের প্রতি অপরিসীম মমত্বের কারণেই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্য' কিশোর কবির কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর ঠেকেছিল। রামায়ণের যে ইচ্ছাকৃত বিকার মধুসূদন ঘটিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কলম। ১২৮৪ বঙ্গাব্দে 'ভারতী' পত্রিকায় কবি ধারাবাহিকভাবে লিখলেন 'মেঘনাদবধ কাব্য' নামক এক সুতীব্র সমালোচনা। সেখানে বাল্মীকি রামায়ণ ও মেঘনাদবধকাব্যের একের পর এক উদ্ধৃতি পাশাপাশি রেখে কবি দেখালেন, কী চরিত্রায়ন, কী পরিস্থিতির বিবরণ, কী ঘটনা-পরম্পরা- কোনওদিকেই মধুসূদন আদিকবির উত্তুঙ্গ কল্পনার নিকটবর্তী হতে পারেননি। বিশেষত, মাইকেলের হাতে পড়ে রামচরিত্রের যে নিতান্ত দুর্দশা ঘটেছিল, সেই বিষয়ে মুখর হলেন কিশোর-

"রামায়ণের নায়ক মহাবীর রাম, মেঘনাদবধ কাব্যের কবি তাঁহার এ-কী দুর্দশা করিয়াছেন। তাঁহার চরিত্রে তিলমাত্র উন্নত-ভাব অর্পিত হয় নাই, এরূপ পরমুখাপেক্ষী ভীরু কোনোকালে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় নাই। বাল্যকাল হইতে রামের প্রতি আমাদের এরূপ মমতা আছে যে, প্রিয়ব্যক্তির মিথ্যা অপবাদ শুনিলে যেরূপ কষ্ট হয়, মেঘনাদবধ কাব্যে রামের কাহিনী পড়িলে সেইরূপ কষ্ট হয়।"

পরিণত বয়সেও কবি যখন বালকের জবানিতে কবিতা লিখেছেন, তখন প্রায়শই তাঁর কল্পনার জগতে ফুটে উঠেছে রামায়ণের কাব্যলোক। 'চিত্রবিচিত্র' কাব্যগ্রন্থের 'চিত্রকূট' কবিতার কিশোর কথক স্মৃতিচারণ করছে, রান্নাঘরের পাশের আস্তাকুঁড়ে একটিমাত্র তেঁতুলগাছের চারাই তার কাছে হয়ে উঠেছিল মুনিঋষি-রাক্ষসদল অধ্যুষিত রামকথার অরণ্যলোক- "একটি মাত্র গাছ সে আমার/ একটুকু সেই কোণ,/ চিত্রকূটের পাহাড়-তলায়/সেই হল মোর বন।" 'শিশু' কাব্যগ্রন্থের 'বনবাস' কবিতায় দেখি, একটি বালক মায়ের কাছে বলছে, বাবা তাকে রামের মতো বনে পাঠালে সে এক্ষুনি যেতে রাজী, কেবল তার একটি লক্ষ্মণ ভাই চাই! বালকের কল্পনায় সে নিজেই হয়ে উঠছে আস্ত একটি খুদে রামচন্দ্র, বলছে- "আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি/ রাম-যাত্রার গান, /মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো, / হাতে ধনুক-বাণ। / চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই/ এম্‌নি বরষাতে--/ লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার/ থাকত সাথে সাথে।"

শেষত, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের কথা একটু বলতে হয়। 'বাল্মীকিপ্রতিভা' ও 'কালমৃগয়া' এই দুটি গীতিনাট্য দিয়েই সদ্যযুবা রবীন্দ্রনাথের জয়যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। দু'ক্ষেত্রেই নাট্যবস্তুর মূলে ছিল রামায়ণ-কথা, এবং দু'ক্ষেত্রেই, রামায়ণের নায়ক-নায়িকা মূল নাট্যব্যাপারে অনুপস্থিত। 'বাল্মীকিপ্রতিভা' নাটকটিকে বলা চলে রামায়ণ রচনার পূর্বপটভূমি, আর 'কালমৃগয়া'-তে রামজন্মের পূর্বাভাস। নাটকদুটির মধ্যে মিল কোথায়? প্রবল ও প্রচণ্ড মৃত্যুশোক থেকে শমে উত্তরণ এই দুই নাটকের প্রধান ঘটনা।

আমরা আশ্চর্য হই। কারণ আমরা দেখি, কবির ব্যক্তিজীবনেও আছড়ে পড়ে একের পর এক মৃত্যুশোক, আর সেই সমস্ত শোকের তীব্রতাকে অতিক্রম করে কবি বারেবারে পৌঁছে যান এক অনন্ত শান্তির নীড়ে। রবীন্দ্রকাব্য ও রবীন্দ্রজীবন, উভয় ক্ষেত্রেই ধ্রুবপদ হয়ে ওঠে একটি অমরবাক্য- "যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।"

Powered by Froala Editor

Latest News See More