তিনি আমাদের সংস্কৃতির অভিভাবক, তিনি আমাদের পরম পিতা। তাই তাঁর সস্নেহ হাতটি আজও শক্ত করেই ধরে আছি আমরা। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৮০ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে প্রায় ৬৮ বছরের কর্মময়তা। তাঁর জীবন উপচে পড়েছে অনন্ত সৃষ্টি সম্ভারে। তিনি যেন দাতা আর আমরা যেন গ্রহীতা। এহেন সৃজনশীল এক প্রতিভা নিজ গুণেই অমর হয়ে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। জন্মের ১৫৯ বছর পরেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা দেখলে বিস্ময় জাগে। রবীন্দ্ররচনাবলি সচেতন বাঙালির ঘরের শোভা বর্ধকই শুধু নয়, প্রাণের রসদ স্বরূপ তথা পরম আশ্রয়ও। নিজেকে যুগাতিক্রমী করে তোলার দুর্লভ ক্ষমতা কিছু স্রষ্টার মধ্যে থাকে, যেটা তাঁর ছিল অধিক মাত্রায়। আর সেই জন্যই তাঁকে শুধু বাঙালি বা ভারতীয় নয় বিশ্ব সংস্কৃতির অভিভাবক বললেও বেশি বলা হবে না৷
এইরকম এক সৃজনশীল প্রতিভা তায় অসাধারণ সুপুরুষ, কাজেই তাঁর জীবনে নারী প্রসঙ্গটি নিয়ে আজও পাঠকের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন রবিজীবনীর সহায়তায় আমরা কিছু তথ্যের সন্ধান করতে পারি। সেক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ভালোলাগা বা ভালবাসা তাঁর জীবনেও এসেছে স্বাভাবিক ছন্দেই। ঠাকুরবাড়ির উদার মুক্ত সারস্বত পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার ফলে নিতান্ত অল্প বয়সেই তাঁর অধিক মানসিক পরিণতি ঘটেছিল। বয়সে বড় নারীরাই তাঁর প্রথম জীবনে সৃষ্টির প্রেরণা।
তখন তাঁর বয়স ১৭, অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নিলেন রবিকে বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টার বা সিভিলিয়ন হতে হবে। ফলে তাঁকে রপ্ত করতে হবে বিলেতি আদব কায়দা। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে কিছুদিন নিজের কাছে আমেদাবাদে রেখে তারপর পাঠিয়ে দিলেন মুম্বইতে। সেখানে পাণ্ডুরঙ্গ পরিবারের কন্যা আন্না তরখরের উপর ভার পড়ে তাঁকে ইংরেজি ভাষা তথা বিলেতিয়ানা শেখানোর। আন্না তাঁর চেয়ে ৬ বছরের বড়ো। অসাধারণ সুন্দরী তথা কেতাদুরস্ত আন্নার তো বেজায় পছন্দ রবিকে। কবি অনুভব করেন আন্নার যৌবনাবেগ তাঁর প্রতি ধাবিত। কবিরও অনুরাগ জন্মায় তাঁর প্রতি। কিন্তু আন্নার শরীরী আহ্বানকে মেনে নেবার মতো সাহস তিনি দেখাতে পারেননি। আন্নার আবদারে কবি তাঁকে একটি নাম দেন - নলিনী। এই নলিনীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন বিস্তর। তাঁর 'কবিকাহিনী' ও 'ভগ্নহৃদয়'-এর নায়িকা নলিনী৷ কাব্য প্রকাশের পূর্বেই আন্নার মুখস্থ হয়ে গেছিল সে সব কবিতা। নলিনী নামে ছোট একটি নাটকও লিখেছেন। কবির জীবনে প্রথম নারী ও প্রথম প্রেম আন্না। কবির অনেক সৃষ্টির উৎস তিনি, সেই প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে না পারলেও আজীবন তা মনে রেখেছেন কবি। প্রবীণ বয়সের লেখা 'ছেলেবেলা'য় সেই স্মৃতি ব্যক্ত করেছেন তিনি।
জীবনের প্রথম লগ্নে ইংরেজিভাষিণী আন্না আর শেষ লগ্নে ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিশভাষিণী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। মাঝে আরো প্রেরণাদাত্রী রয়েছেন অবশ্যই। ভিক্টোরিয়া সংযোগটি ঘটল ১৯২৪-এ। আর আন্না ১৮৭৮-এ। আন্নার বিবাহ হ্যারল্ড লিটলডেল নামে এক স্কচ অধ্যাপকের সঙ্গে হলে তাঁরা বিলেত মানে লণ্ডনে চলে যান৷ দুই কন্যার জন্মের পর আন্না অকালেই মারা যান৷ ফলে কবির সঙ্গে আর তাঁর দেখা হয়নি। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে কবির যোগাযোগ সেটিও বেশ চমকপ্রদ। কবি পেরু রাজ্যের স্বাধীনতার শতবর্ষের উৎসবে যোগ দিতে দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা করেন ১৯২৪-এ। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব তখন এলমহার্স্ট। যিনি শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা তথা পরিচালনায় কবির সহযোগী ছিলেন।
ভিক্টোরিয়া আর্জেন্টিনার এক বনেদি ঘরের রমণী৷ তিনি জানতে পারেন যে কবি আর্জেন্টিনার বন্দর-রাজধানী বুয়েনাস এয়ার্স হয়ে পেরু যাবেন। তিনি ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে বেশ জ্ঞানী৷ ১০ বছর আগেই তিনি কবি ইয়েটস-এর ভূমিকা সম্বলিত গীতাঞ্জলি আর জিদের দ্বারা ফরাসি অনুবাদে গীতাঞ্জলি পড়ে একেবারে মুগ্ধ৷ সেই থেকে রবিঠাকুরের জন্য তাঁর ব্যাকুল প্রতীক্ষা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাজগৎ জুড়ে। ভিক্টোরিয়া সেপ্টেম্বর মাসেই জানলেন কবি আসছেন। কবি এলেন ৬ নভেম্বর (১৯২৪)। জাহাজেই কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, উঠলেন হোটেল প্লাজায়৷ খবরের কাগজে সে সংবাদ পড়েই তিনি ছুটলেন কবিকে দেখতে৷ চিকিৎসকরা নির্দেশ দিলেন কবিকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। ভিক্টোরিয়াও কবিকে পেরু যেতে দিলেন না৷ রাখলেন তাঁরই গৃহে।
বাবার বয়সী একটি মানুষের প্রতি এক আশ্চর্য ভালবাসা অনুভব করতেন তিনি। হোটেল প্লাজা থেকে কবি সান ইসিদ্রোতে মিরালরিও ভিলায় ভিক্টোরিয়ার হেফাজতে স্থানান্তরিত হলেন। কবিকে সাধ্যমতো দেখাশোনা করেন তিনি। তারই সঙ্গে কবির দর্শনপ্রার্থীদের ভিড়কেও সামলাতে থাকেন। তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ কবি৷ ভালবেসে কবি এই প্রিয় নারীটির নামকরণ করেন বিজয়া। তাঁকে উৎসর্গ করেন 'পূরবী' কাব্যটি। বিজয়ার সাহচর্যে এসে বিগতযৌবন কবি প্রেমকে নূতন করে আবার যেন অনুভব করলেন৷ নভেম্বর আর ডিসেম্বরের কয়েকটি দিন বিজয়া সেবা-আদর-যত্নে কবিকে ভরিয়ে তুললেন৷ ফলে কবির সৃষ্টিশীল সত্তা অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ একদিকে লেখা অন্যদিকে ছবি আঁকা৷ কবিকে এই প্রৌঢ় বয়সে আঁকার নেশা ধরিয়ে দিলেন ভিক্টোরিয়া। আঁকা হল প্রায় ২৫০০ ছবি৷ কবির মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখেন বিজয়া। কিন্তু কবিকে এবার ছেড়ে দিতে হবে৷ তিনি ইয়োরোপ পাড়ি দেবেন। কবির আরামের জন্য দামী জাহাজে দুটি কেবিন ভাড়া করলেন তিনি। ভালবাসার মানুষটির সাধের ইজি চেয়ারটিও ক্যাপ্টেনকে বলে দরজা কাটিয়ে কেবিনে ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। দুজনের মধ্যে অন্তরধর্মে প্রভূত মিল থাকায় এমন নিবিড় সখ্য।
১৯৩০-এ আবার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাকে নিয়ে ইওরোপ এলেন কবি। প্যারীতে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী৷ বিজয়াই এ-উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর পরিশ্রমেই প্যারীর Gallery Pigalle-তে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হল। কবি বেজায় আহ্লাদিত। কারণ সেখানকার সমঝদার সমাজ তাঁর ছবির তারিফ করেছেন। বিজয়ার সঙ্গে কবির শেষ দেখা ১৯৩০-এরই জুন মাসে। কবিকে প্যারী স্টেশনে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে কবিকে প্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি৷ কবির জীবনে এই প্রেম বড় অমূল্য সম্পদ। বিজয়ার প্রেমে ত্যাগ ও ভক্তির যে মেলবন্ধন তা কবির মনে পরম তৃপ্তি এনে দিয়েছিল।
রবিঠাকুরের জীবনে নারী প্রসঙ্গের আলোচনায় তাঁর নতুনবৌঠান থাকবেন না, তা তো হয় না। কবির নতুনদা অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে এলেন কলকাতার শ্যামলাল গাঙ্গুলির ৯ বছরের মেয়ে কাদম্বরী দেবী(১৩ জুলাই ১৮৬৮)। জ্যোতিদাদার বয়স তখন ১৯, প্রেসিডেন্সিতে এফ.এ. পড়ছেন। নেহাতই বালিকা কাদম্বরী, জ্ঞানে বিদ্যায় জ্যোতির উপযুক্তনয় বলে ঠাকুরবাড়ির কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু ক্রমে কাদম্বরী নিজেকে গড়ে তুললেন। শিক্ষা- রুচি-আভিজাত্যে মণ্ডিত এক সৌন্দর্য প্রতিমা হয়ে। কবির তখন ৭। শ্যামবর্ণ কাদম্বরীর আশ্চর্য সুন্দর চোখদুটি আর চুল। রবিঠাকুর পরবর্তীতে যখন ছবি আঁকতে শুরু করলেন সেই চোখই তাঁর তুলিতে চলে আসত। নতুন বৌঠানের সঙ্গে তাঁর একটা সহজ সখ্য গড়ে উঠতে থাকে। দুজনের বয়স প্রায় কাছাকাছি। কিশোর রবির সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে চলে তাঁরও পাঠাভ্যাস। কবির ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাহচর্য না পাওয়ায় একটা মানসিক শূন্যতা ছিলই। তারপর তাঁর ১৩ বছর বয়সে মা চলে গেলেন (৮মার্চ ১৮৭৫)৷ এ সময় কাদম্বরী মাতৃহীন দেওরটিকে স্নেহ মমতা দিয়ে আরো কাছে টেনে নিলেন।
১৭ বছর বয়সে কবির বিলেতযাত্রা (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮)। রবি চলে গেলে কাদম্বরী বড় একা হয়ে পড়লেন। কবি ফিরলেন ১৮৮০-র ফেব্রুয়ারিতে৷ নতুন বৌঠানের তো আনন্দ ধরে না৷ ২১ বছরের কাদম্বরীর মনের সকল অনুভূতি রবিকে ঘিরে। কবিরও আন্তরিক ভালবাসা তাঁর প্রতি। বিলেত থেকে ফেরার দেড় বছর পর 'ভারতী'তে প্রকাশিত হল 'য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র'(১৮৮১)৷ বইটি জ্যোতিদাদাকে উৎসর্গিত হলেও পত্রগুলো যে নতুন বৌঠানের উদ্দেশে লেখা তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
জীবনসঙ্গীর ঔদাসীন্য তথা নানান আচরণগত ত্রুটি নিঃসন্তান কাদম্বরীকে মানসিকভাবে অনেকটাই একা করে তুলেছিল৷ রবিকে আঁকড়ে তিনি তাই হয়তো সেই একাকিত্বকেই দূর করতে চেয়েছিলেন। কবির বিয়ের ৩ মাস পর মুদ্রিত হল তাঁর 'ছবি ও গান' কাব্যটি (ফাল্গুন, ১২৯০)৷ নাম উল্লেখ না করলেও এটি যে কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশেই উৎসর্গীকৃত তা বোঝা যায়। ১৮৮৪-র ১৯ এপ্রিল ঘটল ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা। কাদম্বরীর আত্মহত্যা। বিশ্বেশ্বরী তাঁতিনী বাড়িতে কাপড় নিয়ে আসতেন, তাঁকে দিয়েই গোপনে আফিম আনিয়ে, তেতলার ঘরে সেই আফিম খেয়েই জীবনের যবনিকা টানলেন কাদম্বরী। এই মৃত্যু কবির জীবনে বড়ো অভিঘাত বয়ে আনে৷ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন কবি৷ দীর্ঘ ১৭ বছরের যে সম্পর্কে প্রীতি, বিশ্বাস, ভালবাসা, ভালোলাগা তথা শ্রদ্ধা মিশে ছিল তাকে হারিয়ে কবি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন৷ কবির বহু সৃষ্টির উৎসভূমি নতুন বৌঠান৷ শোককে সংযমমন্ত্রে দমন করে তিনি আবার সৃষ্টিতে মেতে উঠলেন৷ তবে আজীবন তাঁর লেখায় ছায়াপাত করেছেন কাদম্বরী।
কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী তাঁর মানসসঙ্গিনী কতটা ছিলেন তা নিয়ে অনেক সমালোচকেরই জিজ্ঞাসা। যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের শুকদেব রায় চৌধুরীর বংশের ঠাকুর এস্টেটের গোমস্তা বেনীমাধবের কন্যা ভবতারিণী দেবীই রবিঠাকুরের পত্নী হয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে৷ বিয়ের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩। তখন তাঁর বয়স ১০, রবির ২২। প্রথম থেকেই শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল, শিক্ষায় তথা আভিজাত্যে সমকক্ষ না হলেও কবি কিন্তু স্ত্রীকে মর্যাদার সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। তাঁর নামকরণ করলেন মৃণালিনী৷ কবির আন্তরিক ভালবাসায় তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর গৃহলক্ষ্মী৷ তবে তাঁদের সুখী দাম্পত্যেও বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে আসে কিছু মৃত্যুশোকে৷ বিশেষ করে কাদম্বরীর আত্মহত্যায়। তবে নববধূর সংযোগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অসুবিধে হয়নি কবির।
নিজগুণে মৃণালিনী দেবী ঠাকুর পরিবারে একটা বিশিষ্ট স্থান করে নিলেন। মহর্ষিরও প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন। নানাবিধ অধ্যয়নের পাশাপাশি পারিবারিক অভিনয়েও অংশ নেন তিনি৷ যদিও তিনি মনেপ্রাণে একজন গৃহিণী, কল্যাণময়ী জননী৷ কিছুকাল পরে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ চলে আসতে হলে কবি অস্থির হয়ে ওঠেন৷ ১৮৯৮-এ কবি স্ত্রী ও সন্তানদের শিলাইদহে নিয়ে এলেন৷ সুখের বন্যা বইলো সংসারে। কবি ও সন্তানদের সুখে রাখাই মৃণালিনীর একমাত্র চাওয়া। কিন্তু শিলাইদহ থেকে তাঁকে চলে আসতে হল শান্তিনিকেতনে। সেখানকার ভবনটি তখনও নির্মিত হয়নি। কাজেই সন্তানদের নিয়ে উঠলেন অতিথিশালায়। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে মা হারা ছেলেদের ভার নিলেন। নিজের সমস্ত গহনা দিয়ে জীবনসঙ্গীর সাধের শান্তিনিকেতন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। অসম্ভব পরিশ্রমে অসুখে পড়লেন তিনি৷ কবি তাঁকে পরিস্থিতি বুঝে কলকাতা নিয়ে এলেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ধারণা তাঁর এপেণ্ডিসাইটিস হয়েছিল৷ কবি চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না৷ কিন্তু সব কিছু ব্যর্থ করে চলে গেলেন মৃণালিনী(২৩ নভেম্বর ১৯০২)। যবনিকা পাত হল ১৯ বছরের দাম্পত্যের। রেখে গেলেন পাঁচ সন্তান।
সবে তখন ৪০ পেরিয়েছেন, পত্নীর মৃত্যুতে সংসার টলোমলো, কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবতেই পারলেন না কবি৷ আজীবন মৃণালিনীর স্মৃতি সযত্নে লালন করেছেন তিনি। সন্তান পালনের কঠিন দায়িত্ব বহন করেছেন৷ তবে সংসারের বন্ধন ক্রমে আলগা করে তিনি তখন থেকেই হয়ে উঠেছেন বিশ্বের। উৎসর্গ কাব্যের ১৬ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখলেন - "হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি/দেখা দিলে আজ কী বেশে৷/ দেখিনু তোমারে পূর্বগগনে,/দেখিনু তোমারে স্বদেশে"৷ শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় বিশ্বভারতীর রূপ পরিগ্রহণ করে তখনই। তিনিও হয়ে উঠলেন বাংলার কবি থেকে বিশ্বকবি।
কবির মানস নির্ভরতা গড়ে উঠেছিল ভাইঝি ইন্দিরার প্রতি৷ কবি তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে চিঠি লিখতেন তাঁকে৷ ইন্দিরার তখন চোদ্দো। ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত (আট বছরের অধিককাল) লিখিত সে সকল চিঠিই ছাপা হয় 'ছিন্নপত্র'-এ (১৯১২)। পরবর্তীতে 'ছিন্নপত্রাবলী'(১৯৬০) প্রকাশিত হয়। ভাবতে অবাক লাগে কিশোরী ইন্দিরা সেগুলি অনুধাবন করতেন কী করে! বোঝা যায় ইন্দিরা কবির অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন৷ যাঁকে কবি অকপটে সব বলতে পারতেন। মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর এই পরমাসুন্দরী কন্যাটির বুদ্ধিমত্তাতেই কবি তাঁকে পরম স্নেহ করতেন ভরসা করতেন৷
সব ভালোলাগা প্রেম নয় ঠিকই, তবে জীবনে কিছু নারী কবির জীবনে পরম মমতার আঁচলখানি বিছিয়ে তাঁকে অধিক সৃজনশীল করেছেন, এ-কথা অনস্বীকার্য৷
Powered by Froala Editor