একদিকে হিমালয়ের মতো পর্বতমালা, আর বাকি তিনদিকে ঘেরা সমুদ্র, এছাড়াও জঙ্গল, মরুভূমি এবং বিস্তীর্ণ সমতল— ভারত বললে এই পুরো ছবিটা আমাদের সামনে ভেসে আসে। শুধুই কি এসব? এর থেকেও অনেক বেশি। ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস— সমস্ত দিক দিয়ে এক বৈচিত্র্যময় সংসারে আছি আমরা। এই দেশ দেখেছে স্বাধীনতার লড়াই, দেখেছে অজস্র বলিদান। ‘জন-গণ-মন’ মন্ত্রে গোটা ভারত আজ এক সূত্রে বেঁধে যায়। কিন্তু ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকালেই বৈচিত্র্য আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। উঠে আসে এমন একটি রাজ্যের কথা, যেখানে তাঁরা নিজেদের জন্যই তৈরি করেছিল আলাদা ‘জাতীয় সঙ্গীত’!
সাল ১৮৮১। মাইসোরের সিংহাসনে তখন বসে আছেন মহারাজা দশম চামারাজেন্দ্র ওয়াডিয়র। সিপাহী বিদ্রোহ পেরিয়ে গোটা ভারত ভালোভাবে নিজেদের হাতে মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে ব্রিটিশরা। তবুও কিছু করদ রাজ্য নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিল। মাইসোর সেরকমই একটি অবস্থানে ছিল। যাই হোক, সিংহাসনে বসার পর নিজের রাজ্যের গরিমা বজায় রাখার জন্য কিছু করার কথা ভাবছিলেন। মহীশূর বা মাইসোরের এমনিই ইতিহাসে একটা বিশেষ স্থান আছে। কিন্তু কালে কালে তার অনেকটাই তো কমে আছে। রাজা দশম চামারাজেন্দ্র সিংহাসনে বসেই উদ্যোগ নিলেন বিশেষ কিছু করার।
জাতীয় সঙ্গীতের মতো ব্যাপার এর আগে ভারতে ছিল না। ভারত তখন ছোটো বড়ো রাজ্য ও রাজার শাসনে ছিল। ফলে একটাই সুর যা গোটা দেশকে একসঙ্গে বাঁধবে, তা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর তাঁদের জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেভ দ্য কিং’কেই এখানকার সঙ্গীত বানায়। এরই মধ্যে এক কাণ্ড করে বসেন মাইসোর রাজ। ১৮৮১ সালে আগস্ট মাসেই নিয়ে আসেন অদ্ভুত এক ভাবনা। এবার মাইসোরের জন্য থাকবে আলাদা ‘জাতীয় সঙ্গীত’! এর আগে আর কোনো রাজ্যে আলাদা করে সঙ্গীতের কথা ভাবা হয়নি। এমনকি, রাজার নিজের সভাকবি বাসাভাপ্পা শাস্ত্রী পুরো কবিতাটি লিখলেন। কার্নাটিক ঘরানার তখনকার কিংবদন্তি বীণাবাদক ভেনে ভাঙ্কটগিরিয়াপ্পা এবং আরও কয়েকজন মিলে সুর তৈরি করেন। তৈরি হয় মাইসোরের নিজস্ব ‘রাজ্য সঙ্গীত’— কায়ায়ু শ্রী গৌরী।
গানের পেছনে বেশ কিছু অদ্ভুত তথ্য চোখে পড়ে। প্রথমত, গানের প্রথম লাইনের আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়াবে ‘গড প্রটেক্ট দ্য কিং’। যা ব্রিটিশদের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মেলে। দ্বিতীয়ত, গানটা যদি একটু ভালো করে শোনেন তাহলে কোথাও একটু খটকা লাগবে। খানিকক্ষণ পর পর্দা একটু একটু করে সরতে আরম্ভ করবে। সুরটার সঙ্গে কোনো একটা চেনা গানের মিল পাচ্ছেন না? হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে করুন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’। সম্পূর্ণ না হলেও, রাগের দিক থেকে অনেকটা মিল পাচ্ছেন না? সেই ঘুরে ফিরে আমাদের মিলিয়ে দিলেন তিনি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সুর মোটেই প্রভাবিত করেনি সেই গানকে। কেননা, মাইসোরের গানটির আট বছর পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে। উল্লেখ্য, বৈদিক গান ‘সংগচ্ছাধম্’ গানটিই উভয়ের সুরের মূল উৎস।
কিন্তু এই পুরো ঘটনাকে অন্য দিক দিয়েও দেখা যায়। আর ঠিক সেটাই ঘটতে লাগল ভারতের অন্যান্য রাজ্যে। নিজেদের একটা স্বতন্ত্র সঙ্গীত করে নেওয়া মানে স্বতন্ত্র গণতন্ত্রকে ঘোষণা করে নেওয়া। ব্রিটিশ রাজত্বে দাঁড়িয়ে একদিক থেকে মাইসোরের প্রতিক্রিয়াই বলা যেতে পারে এটাকে। এমনকি সত্যি সত্যি মাইসোরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন রাজা দশম চামারাজেন্দ্র। এমনকি ভারত স্বাধীন হবার পরও মাইসোরের জন্য আলাদা লোকসভা ছিল। ১৯৪৯ সালে সেসব উঠে যায় এবং পরবর্তীকালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একটা দীর্ঘ ইতিহাস শুরু হয়েছিল যে গানকে দিয়ে, সেই গান কিন্তু অজান্তেই জুড়ে দিয়েছে তিনটে জায়গাকে। এটাই সঙ্গীতের মহিমা!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথকে 'নিষিদ্ধ' বই উৎসর্গ বিপ্লবীর; কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বিশ্বকবিকেও