‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

সূর্যস্নান।। পর্ব ৪।।

বাড়ির বড়ো দাদারা সবাই ইস্কুলে যাচ্ছেআর রবি যাবে নাকান্নাকাটি জুড়ে দিল সে। সেই শুনেগুরুমশায় মাধবচন্দ্র ঠাস করে মারলেন এক চড়। বললেনএখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদছপরে না যাবার জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি কাঁদতে হবে। একেবারে বাস্তব কথা! রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'-তে সকৌতুকে উল্লেখ করেছেন, "এতবড়ো অব্যর্থ ভবিষ্যদবাণী জীবনে আর কোনোদিন কর্ণগোচর হয় নাই।"

কান্নার জোরে ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে অকালে ভর্তি হলেন রবি। সেখানে কী শিক্ষালাভ করলেনসে কথা উত্তরজীবনে আর তাঁর স্মৃতিতে ছিল না। কিন্তুসেই ইস্কুলের একটা জবরদস্ত শাসনপ্রণালীর কথা তাঁর বেশ মনে ছিল। পড়া বলতে না পারলে ছাত্রদের বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়েতাদের দুই প্রসারিত হাতের ওপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একসঙ্গে চাপিয়ে দেওয়া হত। তীব্র ব্যঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "এরূপে ধারণাশক্তির অভ্যাস বাহির হইতে অন্তরে সঞ্চারিত হইতে পারে কি না তাহা মনস্তত্ত্ববিদ্‌দিগের আলোচ্য।" 

ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার সময় শিশু রবি কেবল ছাত্র হয়ে থাকতে চাইলেন নাতাঁরও মাস্টারমশায় হবার শখ হল। তাইঠাকুরবাড়ির বারান্দার একটি বিশেষ কোণে একটি ক্লাস খুলে ফেললেন তিনি। রেলিংগুলো ছিল সেই ক্লাসের ছাত্র! একটা কাঠি হাতে করেচৌকি নিয়ে তাদের সামনে বসে মাস্টারি করতেন এই ক্ষুদ্রকায় শিক্ষকমশায়। রেলিংগুলির মধ্যে কে ভালো ছেলে এবং কে বদ ছেলেতাও স্থির করা ছিল। দুষ্টু রেলিংগুলোর ওপর ক্রমাগত কবির লাঠির ঘা পড়ে পড়ে তাদের এমন দুর্দশা ঘটেছিল যেজ্যান্ত মানুষ হলে তাদের অক্কা পেতে বিশেষ দেরি হত না। লাঠির চোটে যতই রেলিংগুলোর চেহারা বিকৃত হয়ে উঠতততই তাদের ওপর বালকের রাগ বেড়ে যেত। কী করলে যে তাদের যথেষ্ট শাস্তি হতে পারেতা ভেবে কূল পেতেন না শিশু রবীন্দ্রনাথ। 

এই নীরব ক্লাসটির উপরে শিশুকালে এরকম ভয়ঙ্কর মাস্টারি করার স্মৃতিচারণ করে প্রৌঢ় কবি বলেছেনশিক্ষকের শেখানো বিদ্যাটি শিখতে ছাত্রদের যতই দেরি হোকশিক্ষকের ভাবখানা আয়ত্ত করতে তাদের সময় লাগে না। তিনি নিজেই তো তার প্রমাণ! কবি অকপটে জানাচ্ছেন, "শিক্ষাদান ব্যাপারের মধ্যে যে-সমস্ত অবিচারঅধৈর্যক্রোধপক্ষপাতপরতা ছিলঅন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের চেয়ে সেটা অতি সহজেই আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলাম।" রেলিংগুলো ছিল নেহাত নির্বাক ও অচল পদার্থতাই তারা শিশুর সেই অত্যাচার সহজেই হজম করে নিত। তাওএই ঘটনার স্মৃতি কবিকে পরে লজ্জিত করেছেকারণ তিনি বুঝেছিলেনসেই বয়সে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য সঙ্কীর্ণচিত্ত শিক্ষকের মনস্তত্ত্বের লেশমাত্র ভেদ ছিল না। 

কিছুদিন পরে রবি নর্মাল স্কুলে ভর্তি হলেন। তখনও তাঁর বয়স বেশ কম। সেই ইস্কুলেপড়াশোনার কাজ আরম্ভ হবার আগেই গ্যালারিতে বসে সব ছাত্রদের গানের সুরে কী সমস্ত কবিতা আবৃত্তি করতে হত। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের কিছুটা মনোরঞ্জনও যাতে হয়ইস্কুলের এই প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানের মধ্যে নিশ্চয়ই সেই চেষ্টাই ছিল। কিন্তু গানের কথাগুলো ছিল ইংরেজিতার সুরও তথৈবচ- শিশুরা যে কী মন্ত্র আওড়াচ্ছে আর কী অনুষ্ঠান করছেতার কিছুই তাদের মাথায় ঢুকত না। প্রত্যেক দিন সেই অর্থহীন একঘেয়ে কাজটায় যোগ দিতে তারা আমোদ পেত না একেবারেই। অথচ ইস্কুলের কর্তৃপক্ষেরা তখনকার কোনো-একটা থিয়োরি অবলম্বন করে বেশ নিশ্চিন্ত ছিলেন যেছেলেরা এতে দারুণ আনন্দ পাচ্ছে। আদৌ ব্যাপারটা তাদের কেমন লাগছেসে নিয়ে ভেবে দেখবার অবসর তাঁদের ছিল না। যেন তাঁদের থিয়োরি-অনুসারে আনন্দ পাওয়া ছেলেদের একটা কর্তব্যনা পাওয়াটাই সেখানে অপরাধ! 

এইজন্যইযে ইংরেজি বই থেকে তাঁরা এই থিয়োরি সংগ্রহ করেছিলেনসেখান থেকে আস্ত ইংরেজি গানটা তুলে এনেছাত্রদের দিয়ে কোনোরকমে সুরে সুরে আবৃত্তি করিয়ে তাঁরা আমোদিত হয়েছিল। বহু বছর পরে কবি সকৌতুকে জানাচ্ছেন, "আমাদের মুখে সেই ইংরেজিটা কী ভাষায় পরিণত হইয়াছিলতাহার আলোচনা শব্দতত্ত্ববিদ্‌গণের পক্ষে নিঃসন্দেহ মূল্যবান। কেবল একটা লাইন মনে পড়িতেছে-
 কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং।" 

অনেক চিন্তা করে কবি কয়েকটা শব্দের মূল উদ্ধার করতে পেরেছিলেন বটেকিন্তু 'কলোকীকথাটা যে কীসের অপভ্রংশসেটা তিনি একেবারেই বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁর মতেসম্ভবত গানের বাকি অংশটা ছিল কতকটা এরকম - "Full of glee, singing merrily, merrily, merrily"! 

নর্মাল স্কুলের স্মৃতির যে অংশ ঝাপসা নয়রীতিমতো স্পষ্টসেখানেও স্মৃতিকাতর কবি কোনো মাধুর্য খুঁজে পাননি। তিনি বলেছেনসহপাঠীদের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে হয়তো ইস্কুলের স্মৃতি কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু সে কোনোমতেই ঘটার জো ছিল না। অধিকাংশ ছেলের সঙ্গই তাঁর কাছে ছিল "অশুচি ও অপমানজনক"ফলে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র একাকিত্বে ভুগতেন তিনি। মনে মনে শিশু রবি হিসেব করতেনআর ঠিক কত বছর কাটলে এই ইস্কুল নামক যন্ত্রণাটির হাত থেকে ছাড় মিলবে! 

আদর্শ শিক্ষক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মত এই যে, "তাঁরাই শিক্ষক হবার উপযুক্ত যাঁরা ধৈর্যবানছেলেদের প্রতি স্নেহ যাঁদের স্বাভাবিক।" দুর্ভাগ্যবশতশৈশবে এমন কোনও স্নেহপরায়ণ শিক্ষকের সাহচর্য তিনি ইস্কুলজীবনে খুব একটা পাননি। নর্মাল স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একজনের কথা বহু বছর অবধি তাঁর বেশ মনে ছিল। সেই শিক্ষকমশায় এমন কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করতেন যেতাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাবশত রবি তাঁর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন না। সারাবছর তাঁর ক্লাসে সকল ছাত্রের শেষে নীরবে বসে থাকতেন বিরক্ত বালক। জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতেএই অশ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন হরনাথ পণ্ডিত। পরবর্তী জীবনে কবি 'গিন্নিগল্পে ('হিতবাদীপত্রিকায় ১২৯৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত) শিবনাথ পণ্ডিত নামে যে চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেনতা এই হরনাথেরই নামান্তর মাত্রতাঁর ছাঁচেই গড়া। 

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শৈশব থেকেই কবির সংবেদনশীল মন ক্রমাগত ঘা খেয়ে খেয়ে বিরূপ হয়ে উঠেছিল বলেইপরিণত বয়সে তিনি স্বয়ং প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে বোলপুরে স্থাপন করলেন ব্রহ্মবিদ্যালয়। 'আশ্রমের রূপ ও বিকাশপ্রবন্ধে কবি জানিয়েছেন, "অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমার মনে এই কথাটি জেগে উঠেছিলছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে-একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছেযার নাম ইস্কুলসেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না। এই শিক্ষার জন্যে আশ্রমের দরকারযেখানে আছে সমগ্রজীবনের সজীব ভূমিকা।" 

এই সামগ্রিক ও সজীব জীবনবোধইরবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার মূল কথা। তাঁর কাছে শিক্ষা মানে কেবল যান্ত্রিকভাবে কতকগুলো পড়া মুখস্ত করা নয়। শিক্ষা মানে সত্যমঙ্গল ও সুন্দরের দিকে এক অভিযাত্রা- যে যাত্রা আনন্দময়যে যাত্রা অন্তহীন।

Powered by Froala Editor