সূর্যস্নান ।। পর্ব ১
বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ, তবু তাঁর মুখ্য পরিচয় - তিনি কবি। আর তাঁর জীবনে, তাঁর মননে কাব্যবাণীর আবির্ভাব প্রথাগত কাব্য-কবিতার মাধ্যমে নয়, পাঠ্যপুস্তকের নিতান্ত সহজ-সরল চারটি শব্দ থেকে- “জল পড়ে পাতা নড়ে”। ‘জীবনস্মৃতি’ বইতে কবি লিখছেন, “আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।”
এই শব্দ চারটির কাব্যত্ব কোথায়? কাব্যতাত্ত্বিক একে বলবেন চিত্রকাব্য। একটি সহজ-সাধারণ ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছে এই চারটি শব্দ। প্রত্যহের কথাবার্তার তুলনায় এর গাঠনিক চমৎকৃতি এই যে- প্রথমত, মাত্রাগত সামঞ্জস্যের ফলে এতে একটি সরল ছন্দময় চলন রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, এতে রয়েছে ‘অন্ত্যানুপ্রাস’, চলিত কথায় যাকে বলে ‘মিল’। এই ‘কবিতা’-পাঠের স্মৃতি উদযাপন করার সময় কবি জানিয়েছেন, “মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না - তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না…”। শিশুর পক্ষে কবিতার অর্থগত গভীরতা বোঝা ভারী দুরূহ কাজ, সে কানে শুনে যেটি সহজে বোঝে - তা হচ্ছে এই মিল। আর যাঁদের কাব্যানুশীলন নেই, তাঁদের কানেও মিল জিনিসটি ভারী সুশ্রাব্য, ভারী আকর্ষণীয়। তাই, এই ‘কবিতা’-র প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার ভারী প্রয়োজন।
এ ছাড়া, কবির শৈশবে আর একটি জিনিস তাঁকে সহজপাচ্য কাব্যরসের জোগান দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে ছড়া। বাড়ির অনেক কালের খাজাঞ্চি কৈলাশ মুখুজ্যে শিশু রবির মনোরঞ্জন করত অতি দ্রুতবেগে বলে যাওয়া একটি মস্ত ছড়ার মাধ্যমে। সে ছড়ার প্রধান নায়ক শিশু কবি, তার জীবনে এক অলঙ্কৃতা বধূর আসন্ন আবির্ভাবের কথা বলাই সে ছড়ার মুখ্য কাজ। কবি আবারও জানাচ্ছেন, সেই কবিতার বর্ণনীয় বিষয় বা অর্থগত গভীরতা নয়, বালকের মন মেতে ওঠার কারণ ছিল “দ্রুত-উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা এবং ছন্দের দোলা”। ‘বালক’ কবিতায় কবি কিশোরী চাটুজ্যের মুখে দ্রুত লয়ে লবকুশের ছড়া শোনার স্মৃতিচারণ করেছেন। এক্ষেত্রেও, ‘দ্রুত লয়’ ব্যাপারটিই সেই কবিতার এক মুখ্য আকর্ষণ।
“শৈশবের মেঘদূত” অভিধায় কবি যে ছড়াকে অলঙ্কৃত করেছেন, তা হচ্ছে “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান”। ‘লোকসাহিত্য’ প্রবন্ধ সংকলনের অন্তর্গত ‘ছেলেভুলানো ছড়া: ১’ প্রবন্ধে কবি জানিয়েছেন, “এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই।” পরিণত বয়সে ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতাতেও কবি এই ছড়ার মোহমুগ্ধ স্মৃতিচারণ করেছেন।
এই সব “অসংগত অর্থহীন যদৃচ্ছাকৃত” ছড়ার সর্বকালীন, সর্বজনীন আবেদন কোথায়? ‘ছেলেভুলানো ছড়া: ১’ প্রবন্ধে কবি জানাচ্ছেন, ছড়ার প্রধান গুণ এর চিরত্ব। ছড়ার রচয়িতা কে, রচনা কত শকে - এসব তথ্য নিতান্ত গৌণ - ছড়া একইসঙ্গে চিরপুরাতন এবং চিরনূতন। কতকগুলো অসংলগ্ন, কিন্তু বর্ণময় ছবি একের পর এক সাজিয়ে ছড়ার উদ্ভব, তাদের মধ্যে ভাবের বা অর্থের যুক্তিসংগত পারম্পর্য রক্ষার কোনও বালাই নেই, অথচ তা স্বপ্নের মতো সত্য ও সুন্দর।
ছড়ার মধ্যে সহজ কথার আড়ালে ছেয়ে থাকে বাংলার গণমানুষের চিরন্তন বিষাদ। অল্পবয়স্ক মেয়েকে অনিচ্ছায় শ্বশুরবাড়ি পাঠানো বাঙালির চিরন্তন অন্তর্বেদনা, সে বেদনা কত ছড়ার মধ্যে যে কতভাবে লুকিয়ে আছে! এই যেমন, “দোল দোল দুলুনি। রাঙা মাথায় চিরুনি।। বর আসবে এখনি। নিয়ে যাবে তখনি।।” নিতান্ত বালিকাটির জীবনেও যে যখন-তখন বিবাহ নামক একটা কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, শৈশবসঙ্গীদের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম- এই ছোট্ট ছড়াটিতে সে কথাই ফুটেছে। আবার এই প্রতি ঘরের সাধারণ বেদনার মধ্যেই ঢুকে পড়ে হিমালয়-মেনকার বিশেষ বেদনা- “আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে। দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদায়ে।।” এ বেদনা বিশেষের হয়েও সাধারণের, কোনও নির্দিষ্ট কাল বা অঞ্চলের সীমানায় এ বেদনাকে বাঁধা চলে না।
ছড়ার রসকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “বাল্যরস”, কথাটা ভাবের দিক দিয়ে বাৎসল্যের কাছাকাছি। “যিনি বয়সে ক্ষুদ্রতম অথচ প্রতাপে প্রবলতম”, সেই খোকা অথবা খুকুর প্রতি জননীর অপার স্নেহ অজস্র ছড়ার মধ্যে জমাট বেঁধে আছে। স্নেহের বশে তাতে প্রচলিত শব্দগুলিও নতুন এক একটি স্নিগ্ধ সুন্দর রূপ পেয়েছে। পৃথিবীসুদ্ধু লোক বেড়াতে যায়, কিন্তু “খোকা যাবে বেড়ু করতে”; সকলেই জুতো পরে থাকেন, কিন্তু খোকাবাবু পরেন ‘লাল জুতুয়া’! আর, সূক্ষ্মদৃষ্টি কবি জানাচ্ছেন, “যেখানে মানুষের গভীর স্নেহ অকৃত্রিম প্রীতি সেইখানেই তাহার দেবপূজা।” তাই বঙ্গজননী অনায়াসে নিজ পুত্রের সঙ্গে দেবকীর পুত্রকে মিলিয়ে দিয়ে ছড়ার মধ্যে বর্ণনা করেন, “ভাঁড় ভেঙেছে, ননি খেয়েছে, আর কি দেখা পাব। কদমতলায় দেখা পেলে বাঁশি কেড়ে নেব।”
‘ছেলেভুলানো ছড়া: ২’ প্রবন্ধের কবি বাংলার নারীসমাজের মৌখিক পরম্পরায় বাহিত এই সব ছড়াকে বলেছেন “আমাদের জাতীয় সম্পত্তি”। মোট ৮১টি ছড়া তিনি এ-প্রবন্ধে সংকলিত করেছেন। তিনি বলেছেন, একই ছড়ার অজস্র পাঠের মধ্যে কোনোটিই বর্জনীয় নয়, ছড়া জিনিসটা সজীব ও সচল, দেশকালপাত্র অনুযায়ী মানুষ ছড়াকে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির উপযোগী করে তোলে। আজ লোকসংস্কৃতিবিদ্যায় ছড়া নিয়ে যে বিপুল গবেষণা ও কর্মকাণ্ড, তার আড়ালে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা আমাদের স্বীকার করতেই হয়।
শেষ করব ‘ছেলেবেলা’ বইতে কবির বলা একখানা গল্প দিয়ে। শিশু কবি বলিদানের গল্প শুনে এক নতুন খেলা পেয়েছিলেন, কাঠের সিঙ্গিকে কাঠির কোপে বলি দেওয়া। সেই উদ্দেশ্যে তিনি একটি স্বরচিত ছড়াও প্রয়োগ করতেন, কারণ মন্তর ছাড়া তো পুজো হয় না। ‘মন্ত্র’-টি এই – “সিঙ্গিমামা কাটুম/ আন্দিবোসের বাটুম/ উলুকুট ঢুলুকুট ঢ্যামকুড়কুড়/ আখরোট বাখরোট খট খট খটাস/ পট পট পটাস”। এই স্মৃতিরোমন্থনের সময়ে পরিণত-বয়স্ক কবি সকৌতুকে জানাচ্ছেন, আখরোটের প্রতি তাঁর বাল্যপ্রীতির কারণেই ছড়ায় আখরোট শব্দটি নিতান্ত বেখাপ্পার মতন ঢুকে পড়েছে। আর ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিও নেহাত অনর্থক নয়, “খটাস শব্দ থেকে বোঝা যাবে আমার খাঁড়াটা ছিল কাঠের। আর পটাস শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে সে খাঁড়া মজবুত ছিল না।”
শিশু এই ছড়াটি কেবল রচনা করার খাতিরে রচনা করেনি, তার রীতিমতো প্রায়োগিক দিক ছিল, শিশুচিত্তে সেটি ছিল “মন্তর”- পূজার আবশ্যিক অঙ্গ। আর মন্তর বলেই, সুদূর শৈশবের এই স্মৃতি কবি প্রৌঢ় বয়সেও ভোলেননি।
জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে, কবি অনিল চন্দ ও রাণী চন্দকে ‘গীতাঞ্জলি’ বইয়ের “বিপদে মোরে রক্ষা করো” কবিতার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এই-সব কবিতাগুলি মুখস্থ করে রেখে দিস - এগুলো মন্ত্রের মতন।”