ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম পাপুয়ার মারিয়াত জেলায় পাহাড়ের উপর এক একর জমি। সেখানেই চাষ হচ্ছে সরষে শাক, মটরশুঁটি, পালং, মরিচ, টমাটো, তরমুজ, মিষ্টি আলু, কাসাভার মতো শাকসবজি এবং ফল। কিন্তু পাথুরে মাটিতে সত্যিই কি এসব ফলের চাষ করা সম্ভব? হ্যাঁ, এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার (Indonesia) এক-কালের দাগী অপরাধী এমবা গিমবাল (Mbah Gimbal)। তাও সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে (Organic Farming)।
আজ থেকে বছর পঁচিশ আগের কথা। হাঁস প্রতিপালন করেই জীবনযাপন করতেন গিম্বাল। অন্ততপক্ষে প্রায় ১২ হাজার হাঁস প্রতিপালনের পোলট্রি ছিল তাঁর। ডিম তো বটেই হাঁসের মাংসও বেশ জনপ্রিয় খাবার ইন্দোনেশিয়ায়। ফলে, অর্থের অনটন ছিল না। তবে ১৯৯৮-এর এশিয়ার অর্থ সংকটে বদলে যায় পরিস্থিতি। মূল্যবৃদ্ধির জেরে ব্যবসা এসে ঠেকে তলানিতে। কয়েক মাসের মধ্যে এই ফার্ম চালানোই দায় হয়ে ওঠে তাঁর। বলতে গেলে, একরকম দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন গিম্বাল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েই অপরাধজগতে নাম লেখান তিনি।
গিম্বালের বাবা ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সৈনিক। তাছাড়া তাঁকেও বাধ্যতামূলকভাবে কিছুদিনের জন্য পরিষেবা দিতে হয়েছে সেনাবাহিনীতে। ফলে, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। সেটাকেই নিজের পেশা করে নেন গিম্বাল। শুরু হয় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের কারবার। বোর্নিও, জাভা, পাপুয়া-সহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়েই বেশ ভালোরকম ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে চলত অবৈধ বালি-খাদানও।
তবে একুশ শতকের শুরুতেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। জেল খাটতে হয় বেশ কয়েক বছর। সংশোধনাগারের এই দিনগুলোই যেন বদলে দিয়েছিল তাঁকে। কারাবন্দি অবস্থায় রত্নাকর থেকেই হয়ে উঠেছিলেন বাল্মীকি। জেল থকে ছাড়া পাওয়ার পর বোর্নিও-র এক সুফি সন্তের কাছে আধ্যাত্মিকতার পাঠ নেওয়া শুরু করেন গিম্বাল। সেইসঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন পারমাকালচারের।
২০১৮ সাল। বোর্নিও থেকে পাপুয়ার মারিয়াতে সপরিবারে স্থানান্তরিত হন গিম্বাল। তারপর মন দেন কৃষিকাজে। এই সুফি শিক্ষকের পরামর্শেই পাহাড়ের উপরেই গড়ে তোলেন আস্ত এক বাগান। সেইসঙ্গে পাহাড়ে প্রায় আড়াই হাজার গাছের চারাও রোপণ করেছেন এককালের দাগী অপরাধী।
ভারত, নেপাল কিংবা ভুটানের মতো ইন্দোনেশিয়ায় এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি জৈব কৃষিকাজ। চাষের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার হয় সেখানে। তবে গিম্বালের কথায়, অর্গ্যানিক ফার্মিং কোনো নতুন জিনিস নয়। রাসায়নিক আবিষ্কারের আগে মানুষ জৈব উপায়েই ফসল ফলাতেন। প্রয়োজন পড়ত না কারখানা-জাত সারের। পাথুরে মাটিতে ফসল উৎপাদনের বিশেষ পদ্ধতি জানতেন তাঁদের পুর্বপুরুষরা। রাসায়নিক সারের বাড়বাড়ন্ত একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে, তেমনই তার জেরে মুছে যাচ্ছে স্থানীয় ঐতিহ্যও। জৈব কৃষিকে হাতিয়ার করে এই দুই-এর বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন গিম্বাল।
তবে এখানেই শেষ নয়। নিজের কৃষিজমির মধ্যেই ছোট্ট এক পাঠশালাও বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। নাম দিয়েছেন ‘নেচার স্কুল’। স্কুলছুট কিশোর-কিশোরীদের সেখানে খাতায়-কলমে প্রকৃতির পাঠ দেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। লক্ষ্য, আগামীতে পারমাকালচারকে জনপ্রিয় করে তোলা। তবেই না বাঁচবে প্রকৃতি…
Powered by Froala Editor