মানুষের বসতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত গোখরো সাপ। তাকে উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসার জন্য ডাক পড়েছিল বঙ্কিম স্বর্ণকার। ২৮ বছরের বঙ্কিম মালদহ জেলায় স্নেক-সেভার নামেই পরিচিত ছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরের ঘটনাই যে তাঁর জীবনের শেষ ঘটনা হতে চলেছে, এমনটা হয়তো আশা করেননি কেউই। অসাবধানতার মধ্যে সাপটি বঙ্কিমের পা কামড়ে ধরে। তবে তখনও গ্রামবাসীদের সাপ সম্বন্ধে সচেতন করে যাচ্ছিলেন বঙ্কিম। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁর প্রাণ বাঁচানো যায়নি। রাতারাতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ওঠে বঙ্কিমের এই শেষ সাপ উদ্ধারের দৃশ্যটি। তবে এই ঘটনা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও তুলে দিয়ে যাচ্ছে।
“সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতেই দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিম সাধারণ গ্রামবাসীদের যা যা করতে বারণ করছিল, নিজেই কিন্তু সেই একই কাজ করছিল।” বলছিলেন জলপাইগুড়ির সর্পবিশারদ ও সাপ উদ্ধারকারক মানসবন্ধু সরকার। মানসবাবু সহ বাংলার সর্পবিশারদদের প্রায় সকলেই মনে করছেন, এই ঘটনার পিছনে বঙ্কিমের যথেষ্ট ভুল ছিল। ভিডিওতে একাধিকবার দেখা গিয়েছে, সাপটিকে নানাভাবে উত্তেজিত করেছেন বঙ্কিম। কামড় দেওয়ার আগেও একাধিকবার ফনা তুলে ধরেছে সেটি। কিন্তু একজন দক্ষ সাপ উদ্ধারকর্মী কেন এমন অসাবধানে কাজ করবেন? এই প্রসঙ্গে হুগলির সাপ উদ্ধারকারী বিশাল সাঁতরা বলছেন, “এই ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দরকার। আমাদের রাজ্যে তো সেই পরিকাঠামোই নেই। আমরা অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ শুধুমাত্র কয়েকজনের কাজ দেখে দেখে বিষয়টি শিখতে চেষ্টা করেন। ফলে বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়।” যদিও মানসবাবুর মতে, বঙ্কিমের প্রথাগত ট্রেনিং না থাকলেও সে এতদিন নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ সচেতনই ছিল। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে দেখা যায় সে প্রোটোকল লঙ্ঘন করে বারবার সাপদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে।
বঙ্কিমের সঙ্গে একাধিকবার কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে মালদহর আরেক সর্পবিশারদ জয়ন্ত চক্রবর্তীর। তিনি বলছেন, বিগত ১৬-১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কাজ করে আসছিলেন বঙ্কিম। সাপদের উত্তেজিত করা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে অর্থোপার্জনের একটি সুযোগ খুলে গিয়েছে। আর তাতেই প্রলুব্ধ হয়েছিলেন বঙ্কিম। “ইউটিউব, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হতে গেলে সাপটিকে শুধুই উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এলে হবে না। মানুষ সাপের খেলা দেখতে চান, তাই তাদের খেলা দেখাতে হয়।” বলছিলেন জয়ন্তবাবু। অথচ সম্পূর্ণ বিষয়টিই ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী। আইনের প্রসঙ্গ তুলে একাধিকবার বঙ্কিমকে সতর্কও করেছেন জয়ন্তবাবু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই খেলা দেখাতে গিয়েই অকালে প্রাণ হারালেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। বঙ্কিমের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ও বনদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, তাঁর সাপ উদ্ধারের বিষয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ ছিল কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। অথচ যে ব্যক্তি ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কাজ করছেন, তাঁর প্রশিক্ষণ রয়েছে কিনা তা তো আগেই খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিল। সামাজিক মাধ্যমে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বঙ্কিম, যে সুদূর জলপাইগুড়িতে বসেও তার গতিবিধি টের পেতেন মানসবাবু। তাহলে জেলার বনবিভাগ ও প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক বৈকি! এমনকি প্রশ্ন উঠছে বঙ্কিমের চিকিৎসা নিয়েও। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়। অথচ তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ড্রাগ দেওয়া হয়নি বঙ্কিমকে। জয়ন্তবাবু অবশ্য বলছেন, ডাক্তারবাবুর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো জায়গা নেই। তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন। তাহলে কি সেই ড্রাগটি সেই মুহূর্তে কাছে ছিল না? আবার বিশালবাবুর মতে, “চিকিৎসকদের পাঠক্রমেও সাপের কামড় নিয়ে অধিক পরিসর থাকে না। এই নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ শিবিরও হয় না। আর এই কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও সাপের কামড়কে অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগ বলা হয়েছে।” অন্যদিকে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর বিরোধে অপ্রশিক্ষিত কারোর হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সেখানে কেন মানুষকে বারবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হচ্ছে? আসলে সবটা জুড়েই পরিকাঠামোর অভাব থেকে গিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের লোভ। এই দুয়েরই শিকার বঙ্কিম স্বর্ণকার। কিন্তু এই মৃত্যু কি আদৌ সচেতন করল প্রশাসনকে?
Powered by Froala Editor