উনিশ শতকেরও মাঝামাঝি সময়। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ অঞ্চলই যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, সে-সময় সিংহাসনে বসেছিলেন তিনি। শুরু করেছিলেন আধুনিকীকরণ। ব্রিট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন উপনিবেশগুলিতেও। রানি ভিক্টোরিয়া। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম নারী শাসক তিনি। ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে যাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল আফ্রিকা থেকে পূর্ব-এশিয়া পর্যন্ত। তবে মজার বিষয় হল, ব্রিটেনের রানি হলেও, একাধিক ভাষা পড়তে ও লিখতে পারতেন তিনি। আর সেই তালিকায় রয়েছে দু-দুটি ভারতীয় ভাষাও।
কোথা থেকে ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন তিনি? কোন কোন ভারতীয় ভাষায়ই বা পারদর্শী ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া?
ইংল্যান্ডের কেনসিংটন প্রাসাদে ভিক্টোরিয়ার জন্ম এবং বড়ো হয়ে ওঠা হলেও, কৈশোর থেকেই জার্মান ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন তিনি। তার কারণ, জন্মসূত্রে তাঁর মা ছিলেন জার্মান রাজকন্যা। পাশাপাশি রাজকন্যা হওয়ার সুবাদে বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে কৈশোর থেকেই ঘুরে বেড়াতেন ভিক্টোরিয়া। সেই সূত্রেই ইতালিয়ান, ফরাসি এবং ল্যাটিন ভাষার ক্লাস নেন তিনি। ভারতীয় ভাষায় পা-রাখা এরও বহু যুগ পরে, বলতে গেলে মাঝবয়সে।
১৮৭৬ সাল। ভারতের সম্রাজ্ঞীর উপাধি গ্রহণ করেন ভিক্টোরিয়া। ১৯০১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সবমিলিয়ে প্রায় ২৫ বছর ভারত শাসনের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। আর সেই সময় থেকেই ব্রিটেন থেকে চার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ভারতবর্ষের সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করে রানির মনে। কেমন এই উপনিবেশ? কেমন সেখানকার মানুষজন, সেখানকার ভাষা? তবে রাজ্যপাট ছেড়ে যে ভারত পাড়ি দেবেন, সে-সুযোগও নেই। জাহাজে চেপে ভারত পৌঁছাতে লেগে যাবে ৪-৬ মাস। অন্যদিকে তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি বিমান। ফলে, ভারতে অবস্থানরত বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ আধিকারিকদের লেখা থেকেই খিদে মেটাতে হত তাঁকে।
ভারতের সম্রাজ্ঞী হিসাবে অভিষেকের প্রায় ১১ বছর পর এক ভারতীয়ের মুখ থেকেই সরাসরি এই দেশের কাহিনি ও বর্ণনা শোনার সুযোগ আসে ভিক্টোরিয়ার কাছে। এমনকি ভারতের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ও সম্পর্কও গড়ে ওঠে তাঁর। এমনকি এই ভারতীয়ই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর শিক্ষক এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী। না, এই নেপথ্য-ব্যক্তিটি কোনো ভাষাবিদ নন, নন গবেষক, পর্যটক কিংবা রাজপুত্রও। তিনি সামান্য একজন ভৃত্য— আব্দুল করিম।
১৮৮৭ সাল। রানির সিংহাসন অভিষেকের স্বর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আগ্রা থেকে দুই ভারতীয়কে ভৃত্য হিসাবে পাঠানো হয়েছিল ব্রিটেনে। এই দুই ভৃত্যেরই একজন আব্দুল। কিন্তু ৩৩ কোটি ভারতীয়ের মধ্যে থেকে কেন আব্দুলকেই কেন পাঠানো হয়েছিল ব্রিটেনে? একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। আব্দুলের জন্ম ১৮৬৩ সালে। বাবা ওয়াজিরউদ্দিন ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসাকর্মী। অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ-সহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি চিকিৎসক হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন আগ্রার কারাগারে। সেখানে কেরানির চাকরি জুটে গিয়েছিল তাঁর সন্তান আব্দুলেরও। সে-সময় কারাবন্দিদের সম্পর্কে তথ্য ও বিভিন্ন দাপ্তরিক নথি লিপিবদ্ধ করতেন আব্দুল।
সেই সূত্রেই আগ্রার কারাবন্দিদের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। এমনকি ১৮৮৬ সালে ব্রিটেনে রানি ভিক্টোরিয়াকে কারাবন্দিদের তৈরি কার্পেট পাঠানোর জন্য বাছাই-এর দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। তাছাড়া ব্রিটিশ আধিকারিকদের ভারতীয় স্বর্ণকারদের তৈরি সোনার চুড়িও বেছে দিয়েছিলেন তিনি। ভারত থেকে এই উপহার পেয়ে আপ্লুত হয়েই আব্দুলকে ভৃত্য হিসাবে পেতে চান ভিক্টোরিয়া।
চাপরাশি তথা মুন্সির কাজ হলেও, রানির ভৃত্য হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেননি আব্দুল। শুরু হয় ব্রিটেনে যাওয়ার প্রস্তুতি। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে ভারতেই চলেছিল তাঁর প্রশিক্ষণ। রাজপ্রাসাদে কী ধরনের ব্যবহার করতে হয়, কোন আচরণ অশোভন, কোনটা শোভন— এসবই শেখানো হয়েছিল আব্দুলকে।
আব্দুলের সঙ্গে রানির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮৭ সালে। ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনলাভের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের সময়। এরপর ক্রমশ গভীর হতে থাকে আব্দুল ও ভিক্টোরিয়ার সম্পর্ক। প্রায় সারাদিনই আব্দুল সঙ্গ দিতেন রানিকে। শোনাতেন ভারতীয় উপমহাদেশের আশ্চর্য সব কাহিনি, বীরগাথা। তবে তাঁর বেশভূষা দেখে রীতিমতো ঈর্ষান্বিত হতেন ব্রিটিশরাও। সোনার জরির কাজ করা কুর্তা, মাথায় পাগড়ি। ঠিক যেন কোনো দেশের রাজপুত্র। অথচ, কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও রানির থেকে এই খাতির-যত্ন পাওয়ার জন্য অনেকের তীর্যক দৃষ্টিতে দেখতেন আব্দুলকে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ভাষার প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করতে খোদ নিজেই শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন আব্দুল।
সবমিলিয়ে ১৩ বছর রানির ভৃত্য হিসাবে কাজ করেন তিনি। তার মধ্যেই শেষ বয়সে ভিক্টোরিয়াকে উর্দু এবং ফারসি ভাষা শিখিয়েছিলেন আব্দুল। আব্দুলের প্রভাবে এসে উর্দু ভাষায় ডায়েরিও লিখেতেন ভিক্টোরিয়া। এমনকি নাতি প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর খবর ইংরাজির বদলে প্রথমে উর্দুতেই লিখেছিলেন তিনি। ৩ দিন পরে তা ফের লিপিবদ্ধ করেন ইংরাজিতে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, শেষ বয়সে কোথাও যেন ভারতীয় ভাষার কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিলেন ভিক্টোরিয়া। আর আব্দুল?
রানির মৃত্যুর পর ভারতে ফিরে আসেন আব্দুল করিম। তৎকালীন সময়ের অনেকেই দাবি করেছিলেন আব্দুলের সঙ্গে নাকি প্রেমের সম্পর্ক ছিল রানির। পরবর্তীতে গবেষণায় উঠে আসে, এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। নেপথ্যে খোদ রানিরই একটি চিঠি। আব্দুলকে লেখা যে চিঠিতে ভিক্টোরিয়া নিজেকে সম্বোধন করেছেন ‘তোমার স্নেহময়ী মা’ হিসাবে। অবশ্য আব্দুল এবং রানির অধিকাংশ নথি ও চিঠিপত্রই ধ্বংস করে দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। যৎসামান্য যা বেঁচে ছিল, তা সংরক্ষিত করে আব্দুলের পরিবার, বিশেষত তাঁর ভাগ্নে। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে স্থানান্তরিত হলে, ধামাচাপা পড়ে যায় সেই ইতিহাসও।
পরবর্তীতে এইসব ঐতিহাসিক নথিগুলিকে উদ্ধার করেন কবি, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণকাহিনি লেখক ইবনে-ই-ইনশা। বিশ শতকেরও দ্বিতীয়ার্ধে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত করেছিলেন তিনি। তবে তা জনপ্রিয়তা পায়নি সেভাবে। একুশ শতকে এই কাজকে আরও বিস্তারিত রূপ দেন শ্রাবণী বসু। ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আব্দুল : দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য কুইনস ক্লোজেস্ট কনফিডেন্ট’— ২০১০ সালে প্রকাশিত এই বই রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় গোটা বিশ্বে। এই গ্রন্থেই প্রদর্শিত হয় রানি ও আব্দুলের লেখা ডায়েরির বেশ কিছু পাতা ও চিঠিপত্র। সম্প্রতি তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। তবে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শাসক ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন এক ভৃত্যের সৌজন্যে, তা বিশ্বাস করা আজও কঠিন কাজ বইকি!
Powered by Froala Editor