একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কসমেটিক্সের ব্যবহার করে না এমন মহিলা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। প্রতি বছর মেকআপ এবং পারফিউম শিল্পের আয় গোটা বিশ্বে কয়েক বিলিয়ন ডলার। কখনও কখনও রূপচর্চাও যে ঘাতক হয়ে উঠতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক গবেষণা প্রকাশ্যে এনেছে সেই তথ্য। এমনকি ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য রোগও হতে পারে প্রসাধনীর (Cosmetics) ব্যবহারে। তবে প্রসাধনীর এই ঘাতক-সত্তা নতুন নয়। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগেই রূপচর্চার কারণে কঠিন রোগের শিকার হয়েছিলেন স্বয়ং মহারানি প্রথম এলিজাবেথ (Elizabeth I)।
হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এমনটা সত্যি। নিখুঁত মেকআপের বহরই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল রানি এলিজাবেথকে। না, এই তথ্য মনগড়া নয়। চিকিৎসক এবং ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণই ইঙ্গিত দেয় এমনটার। কিন্তু চারশো বছর আগের প্রসাধনী-রহস্যের সমাধান মিলল কীভাবে?
রানি প্রথম এলিজাবেথের যেকোনো তৈলচিত্রের দিকে তাকালেই খানিকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা। কার্যত তাঁর সমস্ত ছবিই বলে দেবে ত্বক, ঠোঁট এবং চুলের জেল্লা বজায় রাখতে নিয়মিত প্রসাধনীর ব্যবহার করতেন তিনি। যা তৎকালীন সময়ের দ্বিতীয় কোনো নারীর ছবিতে অনুপস্থিত। ১৯৭০ সালে ইতিহাসবিদ স্যর রয় স্ট্রং রানির এই রূপচর্চাকে বর্ণনা করেছেন ‘মাস্ক অফ ইয়ুথ’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাঁর ছবিতে। জেল্লা বজায় থাকলেও, ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তাঁর ত্বক। না, শুধু বয়সের কারণে নয়। চিকিৎসকদের অভিমত, মাত্রাতিরিক্ত প্রসাধনীর ব্যবহারই ডেকে এনেছিল বিপদ।
১৫৫৮ থেকে ১৬০৩— দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আয়ারল্যান্ড জুড়ে বিরাট সাম্রাজ্যের রাজত্ব করেছিলেন প্রথম এলিজাবেথ। স্বাভাবিকভাবে তাঁর রূপ এবং আচার-আচরণে ইংল্যান্ডের সর্বোত্তম সংস্কৃতি এবং রাজকীয়তার প্রতিফলন প্রয়োজন। সিংহাসনে বসার পর থেকেই তাই রূপচর্চা নিয়ে সদাসচেতন ছিলেন এলিজাবেথ। তবে তাঁর প্রসাধনী ব্যবহারের মাত্রা ছাড়ায় ষোড়শ শতাব্দীর ষাটের দশকে।
আরও পড়ুন
বাকিংহ্যাম প্যালেসে নাৎসি-আক্রমণের ভয়, বন্দুক চালানো শিখলেন রাজকুমারী এলিজাবেথ
১৫৬২ সাল সেটা। গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ। জীবন নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি হয়েছিল রীতিমতো। শেষ পর্যন্ত তিনি অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করে গেলেও, ঘাতক রোগ ছাপ রেখে গিয়েছিল তাঁর সারা শরীরে। মুখে এবং গলায় তৈরি হয়েছিল গভীর ক্ষতদাগ। এই দাগ ঢাকতেই ‘ভেনেসিয়ান সেরুস’-এর ব্যবহার শুরু করেন এলিজাবেথ। মূলত, সীসা এবং ভিনিগার-এর সংমিশ্রণে তৈরি হত এই প্রাচীন প্রসাধনী। তৎকালীন বেশ কিছু নথি থেকেও জানা যায় প্রায় আধ ইঞ্চি পুরু মেকআপ ব্যবহার করতেন মহারানি। তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য নয়, সকাল থেকে শুরু করে রাত্রি পর্যন্ত একাধিকবার মেকআপের পরত চাপত তাঁর ত্বকে।
আরও পড়ুন
ডাক পেয়েছেন রানি এলিজাবেথের থেকেও, বাঙালিই মনে রাখেনি বিজ্ঞানী মাধবচন্দ্র নাথ-কে
সীসা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক, তা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে সীসাই একমাত্র বিপদের কারণ ছিল না এলিজাবেথের। মেকআপ মুছে ফেলার পর ডিমের খোসা, অ্যালাম এবং পারদের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই বিষক্রিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পারদও।
আজ আমরা অনেকেই জানি, সীসা এবং পারদের উপজাত পণ্যের ব্যবহারে শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়; স্মৃতিভ্রংশ, বিষণ্ণতা, ইরিটেবিলিটির মতো মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। পারদের প্রভাবে ঝরে যায় চুল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দৃষ্টিশক্তি এবং ত্বক। আশ্চর্যের বিষয় হল, এলিজাবেথ এই প্রতিটি সমস্যারই সম্মুখীন হয়েছিলেন। এমনকি সমস্ত চুল ঝরে যাওয়ায় শেষ বয়সে পরচুলাই হয়ে উঠেছিল তাঁর একমাত্র সম্বল।
তবে শুধুই কি রূপচর্চার জন্য এলিজাবেথের এই চড়া মেকআপ? এই নিয়ে বিতর্কও রয়েছে ঢের। ২০১৩ সালে মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি দাবি করেন এলিজাবেথ আদতে ছিলেন পুরুষ। রাজকন্যা এলিজাবেথ মারা গিয়েছিলেন কিশোরী অবস্থাতেই। তবে রাজার থেকে এই সংবাদ লুকাতে গ্রামের এক ছেলেকেই এলিজাবেথ সাজিয়েছিলেন অষ্টম হেনরির দুই কর্মচারী ক্যাটস এবং টমাস। আজীবন তিনিই মেকআপের আড়ালে থেকে রানির ভূমিকা পালন করে গেছেন। বিবাহও করেননি সেই কারণেই। এই লোককথা বেশ প্রচলিত কটসওল্ডেও। সেখানেই নাকি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল কিশোরী এলিজাবেথের। সে যাই হোক না কেন, প্রসাধনীর কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসকের এ-হেন পরিণতির দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যায় না গোটা বিশ্বে। তবে চারশো বছর পেরিয়ে এসে এলিজাবেথের এই ঘটনা থেকে আমরা আদৌ কি কিছু শিখতে পেরেছি? প্রসাধনী দ্রব্যের বিক্রির পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে অন্য গল্প…
Powered by Froala Editor