‘তাহলে কী করবি? ঢুকবি?’
সন্দীপ বলল, ‘হ্যাঁ চল, বাকি মাসটা ভাতে ভাত খেয়েই কাটিয়ে দেব নাহয়!’
সময়টা ২০১৯ সালের মে মাস। ভাগ্যিস সেদিন পকেটের চাপকে পাত্তা না দিয়ে, সহধর্মিণীদের একটা কাছেপিঠেরই স্পোর্টসবারের রাস্তা দেখিয়ে বার্সেলোনার ক্যাম্পনিউ এ্যারেনার ডায়াগোনাল টিয়ারের দুটো টিকিট কিনে ফেলেছিলাম দুজনে! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। ফুটবলে জন্য ইউরোপীয় নাগরিকদের যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের কথা খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় বা ইন্টারনেট ব্রাউজারে পড়তে পড়তে বড়ো হয়েছি, তাকে স্বচক্ষে পরখ করে নেওয়াটাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা। আর হবে নাই বা কেন? যে দুই দলের খেলার কথা বলছি, তার একটার নাম অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ আর অন্যটা সুয়ারেজ-মেসির মতো তারকাখচিত ক্যাম্পনিউয়ের হোম টিম এফসি বার্সেলোনা। একদিকে যেমন খেলার ছন্দের সঙ্গেই বিয়ার গ্লাসের মুহুর্মুহু সমান্তরাল উড়ে যাওয়া অথবা স্কুলে অবধি পা না-রাখা খুদের বাঁধভাঙা বার্সা-প্রীতি আমাদের অবাক করেছিল; অন্যদিকে অ্যাথলেটিকোর ডিসিপ্লিন্ড ছন্দে আমাদের আনন্দিত হতে দেখে আশেপাশের ফ্যানেদের কটমট চাহনি ভয়ও দেখিয়েছিল ততোধিক। সবশেষে জীবনের দুটো পরম মুহূর্তে মেসি আর সুয়ারেজের জোড়া গোল চাক্ষুষ করে মাঠ ছেড়ে বেরতে বেরতে মনে মনে ভেবেছিলাম, আর কিছু চাই না, বাকি জীবনটা মুড়ি বাতাসা হলেই দিব্যি কেটে যাবে!
কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই তো আর একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। নিজের চোখে দেখা, ফুটবল নিয়ে ইউরোপীয় উন্মাদনার গল্প বলতে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, ২০১৮-র জার্মানির দিনগুলোয়, বিশ্বকাপের সময় বেশ কয়েকবার ফ্রনহফার সোসাইটির মতো তাবড় গবেষণাগারের সহকর্মী বিজ্ঞানীরা মিটিংঘরের বিরাট স্ক্রিনে খেলা চালিয়ে কাজকর্ম মাচায় তুলে দিয়েছিলেন। এমনকি গ্রুপ ম্যানেজার নিজে সেই কাণ্ডকারখানার নেতৃত্ব দেন। কী কুক্ষণে বেলজিয়াম-জার্মানি খেলার মাঝে আমি একটা পেটেন্ট এ্যাপ্লিকেশনের কথা তোলায়, ধমকের সুরে ম্যানেজার বলেন, ‘দিস ম্যাচ হ্যাজ ইকুয়াল ইম্পোর্ট্যান্স টু সায়েন্স!’ আমি কাঁচুমাচু মুখে নিজের টেবিল ছেড়ে লাঞ্চ টেবিলে সবার সঙ্গে গিয়ে জড়ো হই। বস্তুত ম্যাচটা জার্মানি হেরেছিল। তারও আগে ইস্তানবুলে থাকতে ২০১৪ বিশ্বকাপে ইউনিভার্সিটির আড্ডাখানায় জার্মানি-ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৫ সালে বেসিকতাশ স্টেডিয়ামে গালাতাসারায়-ফেনারবাহচে ম্যাচের কথাও মনে পড়ে। একদিকে যেমন জার্মানির খেলাটায় সমর্থক জুনিয়াররা যে নেহাতই সৌজন্যবশত আমার ঠ্যাংটি ভাঙেননি সে-কথা মনে পড়ে হাসি পায়, অন্যদিকে আমারই সহকর্মী এরকান, তার সঙ্গে গালাতাসারায়ের হয়ে গলা ফাটানোয় আপ্লুত হয়ে একটা গোটা জে-বি উইস্কির বোতল উপহার দিয়েছিল, সে কথাই-বা ভুলি কী করে? এ সবই তো মধুর স্মৃতি, আর সেসবের মূলে— সব খেলার সেরা খেলা ‘ফুটবল’ (Football)!
কাতারি কেচ্ছা
দুর্ভাগ্যবশত (বা যুক্তিসঙ্গতভাবে?) আজকের ইউরোপের ছবি কিন্তু একেবারেই আলাদা। ২০২২ সালে, কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে গোটা ইউরোপ তথা সারা পৃথিবী বিভক্ত। নিজের চোখে দেখা ফ্রান্স তথা ইউরোপের অন্যান্য দেশের হালহকিকত জানানোর আগে ছোট্টো পরিসরে কাতার-এ বিশ্বকাপ হওয়া নিয়ে মানুষের মনে এত দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস কেন, তা বুঝে নেওয়া যাক। প্রথম সমস্যাটাকে সোশ্যাল মিডিয়া গবেষকরা নাম দিচ্ছেন ‘স্পোর্টসওয়াশিং’, অর্থাৎ সাদা বাংলা বলতে গেলে খেলার নামে চোখে ধুলো দেওয়ার কেরামতি। কাতার যে ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ডকাপ আয়োজন করতে চলেছে, ফিফা এ কথাটা নিয়মমাফিকই জানায় প্রায় ১২ বছর সময় বরাদ্দ রেখে। ব্যাপার হল, কাতার তুলনামূলকভাবে একটি নতুন ও ছোট দেশ। কাজেই ফুটবল বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট সঠিক মর্যাদায় আয়োজন করার মতো অবকাঠামো বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার (স্টেডিয়াম, রাস্তা, মেট্রো ইত্যাদি) তৈরির প্রয়োজন পড়ে বিগত দশ বছরের মধ্যে, যা এই বিরাট মাপের কর্মকাণ্ডের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। ফলত কাতার সরকার নাম-কে-ওয়াস্তে মাস মাইনের প্রলোভন দেখিয়ে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদির মত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলো থেকে হাজারে-হাজারে গরিব কায়িক শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যায়, যাদের তারা সঠিক মানের জীবনধারণ, জীবন-জীবিকা ভারসাম্য, স্বাস্থবীমা ইত্যাদি কোনো সুবিধাই দিতে পারেননি। বস্তুত এই এক দশকে দেশের খোলনলচে পাল্টে ফেলা কর্মকাণ্ডে কাতার সরকারের খরচা হয়েছে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার এবং বিগত এক দশকে অত্যন্ত গরমে অত্যাধিক কায়িক শ্রমজনিত অসুখ যেমন কার্ডিও-ভাসকুলার সমস্যায় প্রায় ৬৫০০ অভিবাসী বা মাইগ্রেন্ট শ্রমিক (একসময় কাতারের জাতীয় কর্মশক্তির ৯৫%) প্রাণ হারিয়েছেন। সরকারের তরফে অবশ্য এই পরিসংখ্যানকে কখনোই মান্যতা দেওয়া হয়নি। ফুটবলের গ্ল্যামারের আড়ালে এই বিশাল ব্যাপ্তির মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামই ‘স্পোর্টসওয়াশ’। বিগত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাই #QatarOnDeadbodies হ্যাশট্যাগটিকে নানান পরিসরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। মানবাধিকারজনিত সমস্যার আরেক দিক অবশ্যই কাতারের মতো মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর লিঙ্গবৈষম্যের সমস্যা। এক্কেবারে বে-আব্রু হয়ে পড়া পুরুষতন্ত্র, নারীবিদ্বেষ, এলজিবিটিকিউএ+ সম্প্রদায়ের উপর বিরামহীন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার ইত্যাদি কাতারের সামাজিক পরিসরের দৈনন্দিন অঙ্গ। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে রেইনবো পতাকার ব্যবহার বা এলজিবিটিকিউএ+ সম্পর্কিত পোস্টে লাইক বা কমেন্টও শারীরিক আক্রমণের কারণ হতে পারে। এ-সমস্ত সমস্যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিশ্বকাপ শুরুর আগে ক্রমাগত আসতে থাকা লিঙ্গসাম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একের পর এক খবর। এ-মাসেই যেমন কাতার জাতীয় দলের পূর্বতন খেলোয়াড় তথা ২০২২ বিশ্বকাপের অন্যতম প্রতিনিধি খালিদ সালমান খোলাখুলি জানান, ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি এখানে হারাম। ও জিনিস হারাম কারণ তা মানুষের মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ তার উপর এসবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিফার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে বা ফ্রান্সের নামকরা পিএসজির মত ক্লাবকে অসম সুবিধা ও অর্থ সাহায্য পাইয়ে বিশ্বকাপ ‘হোস্ট’ করার অধিকার চুরির অভিযোগ।
যা দেখছি যা শুনছি
উপরিউক্ত কাণ্ডকারখানার ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী যা যা ঘটে চলেছে, তা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমাদের কারোরই দৃষ্টির অগোচর নয়। কয়েকদিন আগেই মন্টেক্লেয়ার ইউনিভার্সিটির ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’ গবেষণাগারের সোশ্যাল মিডিয়া গবেষকরা এই বিষয়ে টুইটারে ঘটে যাওয়া অনলাইন বিক্ষোভ এবং তার ফলস্বরূপ রাস্তায় নামা প্রতিবাদ-বিষয়ক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে দেখান যে, খেলার দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভের ‘ক্লাস্টার-সাইজ’ ক্রমশই বাড়ছে।
ফ্রান্সের নিস শহর, যেখানে আমার বিগত ৪ বছরের জীবন-জীবিকা, সেখানে কয়েক মাস আগেই ফরাসি লিগের ফাইনালে পিএসজির বিরুদ্ধে নিসের ঘরের টিমের খেলা নিয়ে হুটোপুটি পড়ে গিয়েছিল; তা আমার নিজের চোখে দেখা। এমনকি অফিস থেকে ফেরার পথে পিএসজির টিম-বাসের পিছনে ঘণ্টা খানেক লম্বা লাইনে আটকেও ছিলাম। কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে মানুষের তেমন ব্যাকুলতার লেশমাত্র চোখে পড়েনি এখনও। কথায় কথায় নিজের রিসার্চ টিমের জঁ, লার্স, জেরেমিদের জিজ্ঞেস করাতেও তেমনই উত্তর পেয়েছি। প্রায় সকলেই সোজাসুজি জানিয়েছে ফুটবলের মতো পবিত্র জিনিস নিয়ে এমন নোংরামো ফরাসিরা মেনে নেবে না কখনই! তারা প্রত্যেকেই এবারের ওয়ার্ল্ডকাপ বয়কট করছে। আমার পাড়ার মোড়ের কাফে মালিক আর বুলাঞ্জ-এর মুখেও একই কথা। নিস শহর পরিশদ প্রত্যেকবারের মতো এবারও ঢালাও খেলা দেখার বন্দোবস্ত করলেও তারা এবং তাদের পরিবার-বন্ধুবান্ধব কেউই কোনো খেলাই দেখবেন না। কদিন আগেও যাঁরা ভোটের সময় ফরাসি রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রঁ-র উপর নানান কারণে ক্ষেপে ছিলেন, তাঁদের মুখে এই বিষয়ে এক্কেবারে অন্য সুর। ট্রাম চালক থেকে ফুল বিক্রেতা, দুই-একজন ছাড়া প্রায় সকলেই জানালেন তাঁরা রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত। বস্তুত কদিন আগেই ম্যাক্রঁ-অফিস থেকে জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘খেলাধুলোর রাজনীতিকরণ হওয়া উচিত নয়। এই ধরনের প্রশ্নগুলো যে-কোনো ইভেন্ট আয়োজন করার অধিকার প্রদানের সময়েই করা দরকার। বিশ্বকাপ হোক বা অলিম্পিক, হোস্টিং-এর সিদ্ধান্তের সময় এই কথাগুলো হওয়া প্রয়োজন। এখন খেলা শুরুর আগমুহূর্তে এই তর্কের কোনো মানে নেই।’
আজ থেকে শুরু হচ্ছে ২২তম ফুটবল বিশ্বকাপ। ৪ বছর পর আবার বিশ্বজয়ের যুদ্ধে যাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। অন্যবারের মত বহু মানুষ কাতার পাড়ি দিলেও গোটা মহাদেশ মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিভক্ত। খেলার দিন যত এগিয়ে এসেছে, #বয়কটকাতার ঝান্ডা নিয়ে আরও তেড়েফুড়ে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শহরের রাজপথ। এ দৃশ্য আর যাই হোক ফুটবলের ক্ষেত্রে কাম্য ছিল না। এই যেমন এই কথাগুলো এখন যে দেশের মাটিতে বসে লিখছি, ১৯৯৪ সালে রোবার্তো বাজ্জিও পেনাল্টি মিস করার পর থেকেই সে দেশের ফুটবল আমার নয়নমণি। রোমের হোটেলের বেয়ারা থেকে ভেনিসের কফিশপের ছেলেটি, দুজনের মুখে একটাই কথা, ‘অন্য বছর সুযোগ না পেলে আক্ষেপ থাকত, এ বছর তো ফুটবল হচ্ছে না রাজনীতি হচ্ছে। কাজেই এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে।’ প্রথম প্রথম শুনে ‘আঙুর ফল টক’ মনে হয়েছিল বটে, তবে, ইতালির দুপ্রান্তের দুটো শহরের দুজন অজানা অচেনা মানুষ একই কথা বলায় মনের খটকাটা থেকেই যাচ্ছে। তবে কি খেলার মাঠে রাজনীতির অনুপ্রবেশটাই এরপর নিউ নর্মাল হয়ে দাঁড়াবে? ফিফা যদিও মানতে নারাজ, তবে এ প্রশ্নের সদুত্তর সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর গতিই বা কী! ততদিন বুকে আশা রেখে আমরা বরং বলব—
‘Without football any life is worth nothing!’ – ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো
Powered by Froala Editor