সেখানে পলাশের লাল আভাই জানান দেয় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। পথঘাট, মাঠ রাঙা হয়ে ওঠে ছড়িয়ে থাকা পলাশ ফুলের পাপড়িতে। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে পুরুলিয়া, জঙ্গলমহল নিয়েই। এবার সেই পলাশ ফুলের শুকনো পাপড়ি দিয়েই তৈরি হল ভেষজ আবির। নেপথ্যে রয়েছেন প্রাচীন জনগোষ্ঠী বীরহোড় সম্প্রদায়ের মহিলারা। শুধু পুরুলিয়া কিংবা জঙ্গলমহলই নয়, বসন্ত উৎসবে গোটা বাংলাই রাঙা হয়ে উঠছে বীরহোড় মহিলাদের তৈরি এই পলাশ-আবিরের আভায়।
সবমিলিয়ে ভারতে যে ৭৫টি বিপন্নপ্রায় উপজাতি সম্প্রদায় রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বীরহোড়। কমতে কমতে মাত্র ৪১০-এ এসে ঠেকেছে তাঁদের জনসংখ্যা। “শিক্ষার সমস্যা তো রয়েছেই, পাশাপাশি এঁরা প্রত্যেকেই প্রায় অপুষ্টির শিকার। জনস্বাস্থ্য বা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে এঁদের কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। যদি তাঁদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে তাঁদের”, বলছিলেন ‘মৈত্রেয়’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সপ্তর্ষি বৈশ্য।
বছর তিনেক আগে এই লক্ষ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর লড়াই। মাটির ভূমিপুত্র হওয়ায় বীরহোড় জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবন-জীবিকাও নির্ভর করে জঙ্গলের ওপরেই। তাঁদের স্বনির্ভির করে তুলতে, তাই বনসম্পদকেই হাতিয়ার হিসাবে তাঁদের হাতে তুলে দেন সপ্তর্ষি এবং তাঁর সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। একাধিক কুটীর শিল্পের প্রশিক্ষণ দেন গ্রামের বীরহোড় মহিলাদের। যার মধ্যে রয়েছে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্য চাষ, বনজ ফল থেকে আচার তৈরি, শাল পাতার থালা কিংবা ঔষধি-ভেষজ উদ্ভিদকে বাজারজাত করা-সহ একাধিক কর্মকাণ্ড। সেই তালিকাতেই নবতম সংযোজন পলাশ ফুল এবং বীটের মূল দিতে তৈরি এই আবির। বীরহোড়দের স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘বাঁহা সাঁদেশ’। যা সম্পূর্ণভাবেই ভেষজ।
বাংলার বুকে সবমিলিয়ে মাত্র পাঁচটি বীরহোড় গ্রাম রয়েছে। বিগত তিন বছরে সেখানে বীরহোড় মহিলাদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন সপ্তর্ষি। আর তাঁদের হাত ধরেই বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই আবির। তাঁদের তৈরি এই ভেষজ আবিরকে বাজারজাত করছে সপ্তর্ষির তৈরি পৃথক একটি সংস্থা 'আনাড়ি'-সহ একাধিক বিপণন কেন্দ্র। বেশ কিছু গবেষকও জড়িয়ে রয়েছেন এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। সপ্তর্ষির কথায়, “কলকাতায় আপনজন-সহ বেশ কিছু যৌথ সমবায়ের মাধ্যমে এই আবির বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরুলিয়া, আসানসোলেও বেশ কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে এই আবির।” শুধু দূষণ বা রাসায়নিকমুক্ত বসন্ত উৎসব-পালনই নয়, বরং এই ভেষজ আবির যেন নতুন করে রঙের প্রলেপ দিচ্ছে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনেও…
Powered by Froala Editor