একটা রুগ্ন, রংচটা বাইসাইকেল। সামনে বাঁধা লোহার টিন। তাতে ভর্তি করা জল। সাইকেলের হাতলে ঝোলানো ব্যাগে রাখা কাস্তে, কাঠারি। প্রতিদিন সকালের আলো ফুটলেই খাটো ধুতি পরে এই সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়েন তিনি। দুখু মাঝি। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির সিন্দরী গ্রামের এই বাসিন্দাই হাজার দুয়েক গাছের অভিভাবক। সকাল থেকে শুরু করে একদম সন্ধে, এভাবেই গ্রামের পথে পথে ঘুরে গাছেদের পরিচর্যা করেন তিনি।
একেবারে কিশোর বয়স থেকেই এই লড়াইতে নেমেছিলেন তিনি। তারপর থেকে বৃক্ষরোপণ একরকম নেশাই হয়ে গেছে তাঁর। গ্রামের মাঠে মাঠে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেন বট, অশ্বত্থ, আমি, জাম, বকুল, মহুয়ার বীজ। সেখান থেকে প্রথমে চারা তৈরি, তারপর অপেক্ষা বর্ষা আসার। মরশুম এলেই, গ্রামের দু’ধারে সার দিয়ে তিনি রোপণ করেন সেসব গাছের চারা। ষাটের কোঠায় এসেও এতটুকু খামতি পড়েনি সেই উদ্যোগে।
তবে গাছ রোপণ করলেই তো আর কাজ ফুরিয়ে যায় না। তাদের পরিচর্যাও তো দরকার। পুরুলিয়ার গ্রামে অভাব নেই গবাধি পশুর। কাজেই, অকালমৃত্যু থেকে সন্তানদের বাঁচাতে বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন তিনি। জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ, গাছের ডাল জোগাড় করে এনেই তৈরি করলেন প্রতিরক্ষা বেষ্টনী। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটল না। হামেশাই উধাও হয়ে যেতে থাকল সেসব বেড়া। আসলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এখনও রান্না করেন কাঠের উনুনে। রাস্তার পাশ থেকেই যদি এভাবে কাঠ পাওয়া যায়, তবে কে-ই বা আর কাঠ সংগ্রহ করতে যাবে জঙ্গলে? তবে উপায়?
আরও পড়ুন
১৫৫টি গাছের ঔষধি গুণ নখদর্পণে, বিনামূল্যেই চিকিৎসা করেন অশীতিপর ভাষাসৈনিক
সমাধান খুঁজলেন দুখুবাবু। কাজে লাগালেন গ্রামবাসীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতাকে। বেড়ার জন্য তিনি বেছে নিলেন শ্মশানের চিতাকাঠ, মৃতের শাড়ি-ধুতি কিংবা শেষকৃত্যে ব্যবহৃত খাট। তা দিয়েই তৈরি হল গাছের বেড়া। বাঘমুন্ডি, বীরগ্রাম বা সিন্দরীতে গেলে হামেশাই রাস্তার ধারে দেখতে পাওয়া যাবে এই দৃশ্য। না, গ্রামবাসীরা খানিকটা অশরীরীর আতঙ্কের আর ধারে ঘেঁষেন না এই বেড়ার।
আরও পড়ুন
এই প্রথমবার নির্দিষ্ট হবে গাছের মূল্য, আইন আনতে চলেছে সুপ্রিম কোর্ট
আরও পড়ুন
পেরেকের যন্ত্রণা থেকে গাছেদের মুক্তি দিতে, ৭ জেলা ঘুরে ঢাকায় ওয়াহিদ সরদার
তবে তাঁরা কি উপকৃত হচ্ছেন না এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে? “সম্রাট অশোক যেভাবে রাস্তার দু’ধারে গাছ লাগিয়েছিলেন সার দিয়ে, একদম সেভাবেই গাছ লাগান দুখুবাবু। অথচ উনি সেই তত্ত্ব জানেন না। তবে গ্রামবাসীরা গরমের দুপুরে রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় একটু ছায়া পাবে, সেটাই ওঁর উদ্দেশ্য”, বলছিলেন সিন্দরী গ্রামের সমাজকর্মী উদয় কুমার।
উদয়বাবুর থেকেই জানা গেল, কোনোদিন স্কুলে যাননি দুখু মাঝি। অথচ, পরিবেশ আর মানবতার শিক্ষা তাঁর থেকে ভালো আর কে-ই বা দিতে পারবে? পুরুলিয়ার আরেক সমাজকর্মী দুর্গাদাশ মাহান্তী জানালেন, সব মিলিয়ে পরিণত হয়েছে তাঁর লাগানো প্রায় ২২০০ গাছ। যদিও এই পরিসংখ্যান ২০১৯ সালের। তবে শুধু গাছ লাগানোই নয়, সচেতনতা তৈরিতেও সফল হয়েছেন তিনি। বর্তমানে গ্রামের বাসিন্দারা নতুন চারা সন্ধান পেলেই খবর দেন দুখুবাবুকে।
শুধুমাত্র বার্ধক্যভাতার ওপরে নির্ভর করেই সংসার চালাচ্ছেন তিনি। সামান্য টাকার অধিকাংশটাই চলে যায় অসুস্থ ছোটো ছেলের চিকিৎসায়। বাড়ি-ঘরও ভগ্নপ্রায়। তবু তার সামান্যতম প্রভাব পড়ে না সদাহাস্যময় মুখে। এ পৃথিবীকে যে তিনি শিশুর বাসযোগ্য করে তুলছেন। তার থেকে বড়ো সাফল্য আর কীই বা হতে পারে? বার্ধক্যে এসেও তাই নিরলসভাবে গাছের অভিভাবকত্ব করে চলেছেন পুরুলিয়ার এই প্রকৃতিসাধক…
ছবি ঋণ— দুর্গাদাস মাহান্তী
Powered by Froala Editor