১৯৯৯ সাল। সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ। গঙ্গার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা লঞ্চ। তার ধারে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়। উথাল পাথাল জল পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যান। ঘোলা জলে ভেসে আসছে পানা, কাগজ অথবা প্লাস্টিকের টুকরো। প্রৌঢ়ের ভেতরটাও নদীর মতোই আওয়াজ তুলছে। কখনও ডুবছেন, কখনও উঠছেন। আলো দেখতে চাইছেন; কিন্তু পাচ্ছেন কি? অজস্র প্রশ্ন করে গেছেন এতদিন। নদীর ঢেউ প্রশ্নগুলোর গায়ে আরও একবার দোলা লাগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সেই প্রৌঢ় দিলেন এক ঝাঁপ। আশেপাশের সহযাত্রীরা ছুটে এলেন। ততক্ষণে গঙ্গার বুকে মিলিয়ে গেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিন যিনি লিখেছিলেন, ‘জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা/ ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই/ রেলের লাইনে মাথা রাখি/ কে যেন হঠাৎ বলে/ আয় কোলে আয়/ আমি তো আছি’। কে জানত, নিজের শেষদিনের কথাই রেখে যাচ্ছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কিংবদন্তি এই গীতিকার! লঞ্চের সহযাত্রীরাও কি চিনতে পেরেছিলেন?…
বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়া কি ভাবা যায়? একের পর এক স্মরণীয় গান দিয়ে গেছেন। আজও খোলা আকাশে বা বদ্ধ ঘরের মনখারাপে গুনগুন করে উঠি আমরা সেই কথা। যেন কত আপন! কবিতা লিখতেন একসময়। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছেপেও বেরোত। তখন নেহাতই কচি বয়স; কিন্তু উত্তেজনা কম ছিল না। কবিতার খেলা কখন যে সুরে সুরে জড়িয়ে যাবে, জানতেন না পুলক। সেই ছোট্ট বয়সেই গান লেখা শুরু। প্রেমের গান, বিরহের কথা। বাড়ির লোককে সেসব দেখানো যায় নাকি! ‘পাকা ছেলে’ বলে দু-চার কথা শুনিয়ে দেবে বরং। শেষে নৌকা ভিড়ল জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তখন সিনেমার প্রযোজক। শ্যালকের এমন গুণ দেখে আর আটকে রাখতে চাননি সরোজবাবু। ভাগ্যিস!
সিনেমা থেকে থিয়েটার, রেডিও— সব জায়গায় কথার ডালি নিয়ে হাজির হতেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শব্দে ভর করে সুরকার, গায়করা জাল বুনতেন। প্রথম রেকর্ড হওয়া গানটি সিনেমার অঙ্গ ছিল না। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় বেজে উঠেছিল ‘এবার আমি মা চিনেছি’। কি আশ্চর্য সমাপতন! জীবনের একদম শেষ লগ্নে এসেও সেই শ্যামা মায়ের কথাই বলেছেন পুলকবাবু! ১৯৯৮ সালে মান্না দে’র গাওয়া ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’ দিয়েই শেষ হয় তাঁর যাত্রা। এই ‘একটু জায়গা’ পাওয়ার জন্যই কত আকুতি, কত জায়গায় যাওয়া!
মান্না-পুলক জুটি বাংলা সিনেমায় নিয়ে এসেছেন একের পর এক গান। আর গানের পেছনেও কত শত গল্প! একবার মান্না দে গেছে ধানবাদে গান গাইতে। সঙ্গী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই কিনা শ্যালিকার বাড়ি, একটু খোঁজ খবরও নিয়ে আসা যাবে। পুলকের অনুরোধে মান্না দে-ও যেতে রাজি হলেন। কিন্তু শ্যালিকার বাড়ির ঠিকানাটা ঠিক মনে পড়ছে না। গাড়িতে যেতে যেতে গায়ক বলছেন নতুন গান বানানোর কথা। এইচএমভি রোজ তাগাদা দিচ্ছে যে! যাই হোক, একটা বাড়ির সামনে হাজির হলেন পুলকবাবু। দরজা খুললেন একজন অপরিচিতা ভদ্রমহিলা। অসম্ভব সুন্দরী। বুঝতে পারলেন, ভুল ঠিকানায় এসে গেছেন। আসল ঠিকানার খোঁজ জেনে নিয়ে ফিরে এলেন গাড়িতে। আর সঙ্গে সঙ্গে মান্না দে-কে বললেন, ‘আপনার গান তৈরি হয়ে গেছে।’ পরের দিন সকালে লিখে ফেললেন ‘ও কেন এত সুন্দরী হল।’ বাকিটা, ইতিহাস…
এরকম গল্প জড়িয়ে আছে আরও অনেকের সঙ্গে। তালিকা খুললে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। একটা ছোট্ট ঘটনায় আসা যাক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে গান গাইতে গিয়েছেন গায়িকা হৈমন্তী শুক্লা। ফিরে আসার পর তুমুল বিতর্ক। কোনো কারণ ছিল না; কিন্তু কেন যে শুরু হল। হৈমন্তীর কেরিয়ার খাদের ধারে। কী হবে এবার? ছুটে গেলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। দুজনে মিলে গেলেন মান্না দে’র বাড়ি। ওঁর বাড়িতেই পুলকবাবুর লেখা একটি গান ছিল। ঠিক হল, সেটাই হৈমন্তীকে দিয়ে গাওয়ানো হবে। তৈরি হল ‘আমার বলার কিছু ছিল না/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে…।’ আজও হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই গানটি। বাকি কথা বলার কি অবকাশ আছে আর?
প্রেমের গান হোক, বা মজার— যে কোনো পরিস্থিতির গানের কথা বললে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলম চলত হনহনিয়ে। কখনও রাস্তা দিয়ে আসছেন, মান্না দে একটা ঠুংরি গেয়ে পুলককে বলছেন এর ওপর গান বানাও। তক্ষুণি বানিয়ে ফেললেন, ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’। ‘প্রথম কদম ফুল’-এর জন্য গান লিখতে হবে। বাড়ি গিয়ে দেখলেন, মান্নাবাবু নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে গেছেন। ওদিকে খাবার তৈরি হচ্ছে, আর এদিকে কলম চলছে পুলকবাবুর— ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’। কখনও বিমানসেবিকাকে দেখে ন্যাপকিনে লিখে রাখছেন- ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’। রূপকথার মতো একেকটা কাহিনি। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুর, ছন্দ আর কথার জ্যোৎস্না। আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ম্যাজিক!
আরও পড়ুন
বাঁকুড়ায় গুলিবিদ্ধ প্রাচীন মল্লবংশের বর্তমান রাজা; আত্মহত্যা না খুন? ধন্দে পুলিশও
একটা প্রশ্ন আজও তাঁর ভক্তদের মনে দানা বেঁধে আছে। কী এমন হল, যে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল? জীবন তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে। তাও কি শেষবেলায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন? এত খ্যাতির পরেও কলম নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল? কবিতায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘এত যে শোনাই গান তবু মনে হয়/ যে গান শোনাতে চাই হয়নি গাওয়া’। আর গানে তো বলেইছিলেন গঙ্গার বুকে ঝাঁপ দেওয়ার কথা। নিয়তির টান কি বুঝতে পারি আমরা? শিল্পীর অস্বস্তি তিনি নিজেই বুঝতে পারেন; তাঁর হেরে যাওয়া শরীরটার দিকে ছুঁড়তে ইচ্ছা করে পাথর। একা কারাগারে শিল্পী মৃত্যুর দিন গোনেন। কখনও কখনও নিজেই চলে যান সেই অন্ধকার কুয়োর কাছে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছিল? নাকি ক্রমশ যুগের বদলে যাওয়া, গানের ভাবনা বদলে যাওয়া তাঁকে খাদের চরম জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল?
উত্তর নেই। আসবেও না আর। মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে ফুলে ওঠা দেহটা নিজেই একটা জবাব হয়ে থেকে গেল। দীর্ঘদিনের সাথী মান্না দে এমন খবর শোনার পর ভেঙে পড়েছিলেন। “ভবিতব্যকে পালটাতে পারতাম না জানি, তবু বলতাম, অন্তত এটুকু বলে যান কেন এরকম দুঃখের ভার বয়ে বেড়িয়েছেন আপনি দিনের পর দিন? কী ছিল আপনার দুঃখ?” চোখের জল ফেলতে ফেলতে এটাই বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন মান্না। পরে যতবারই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা এসেছে, শুধু চোখের জলই পড়েছে তাঁর। আর পুলক? তখন তিনি অন্য রাজ্যের ঘোড়া। গঙ্গার বুকে তাঁর এক পায়ের চটিটা হয়ত ভেসে বেড়াচ্ছে আপনমনে।
তথ্যসূত্র-
আরও পড়ুন
আত্মহত্যা করেননি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ; হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে!
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘কথা দাও আবার আসবে’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘সুরের ওপর গান লেখার আশ্চর্য গুণ’
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জনক হয়েও পাননি স্বীকৃতি, অবসাদ-অপমানে আত্মহত্যা ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের