করোনা পরিস্থিতিতে সমস্ত বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের মতোই ক্ষতির মুখে পড়েছে কলকাতার বই বিপণনের জগতও। তার মধ্যে আমফানের কবলে গিয়েছে বহু বই। সব মিলিয়ে প্রকাশকরা দিশেহারা। এর মধ্যেই এগিয়ে আসছে কলকাতা বইমেলার সময়। পাঠকদের কাছে তো বটেই, প্রকাশকদের কাছে বছরের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। তবে এখনও কলকাতা বইমেলা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারেনি পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবছেন প্রকাশকরা? জেনে নেওয়া যাক তাঁদের বয়ানেই…
অপু দে (দে’জ পাবলিকেশন)
এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, সারা বছরই করোনার কারণে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তারপর আমফানের ঝড়ে প্রচুর বই নষ্ট হয়েছে। তবে এই পরিস্থিতিতে অনলাইন বিপননের একটা জায়গা খুলে গিয়েছে। এবছরও জেলা বইমেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কীভাবে বইমেলা হয় দেখা যাক। আশা রাখছি দেরিতে হলেও কলকাতা বইমেলা হবে। আর তখন নতুন করে হয়তো খানিকটা লাভের মুখ দেখব।
সুকল্প চট্টোপাধ্যায় (আজকাল)
আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। পাঠকদের মতোই সংশয়ে আছি আমরা। বইমেলা আদৌ হবে কিনা, এটাও যেমন প্রশ্ন; তেমনই মেলা হলেও কি উপযুক্ত ব্যবসা করে ওঠা যাবে? এখনও পর্যন্ত কোনো প্রকাশকের হাতেই খুব বেশি সংখ্যক নতুন বইও নেই। তাছাড়া স্বাস্থবিধি মেনে আদৌ কি বইমেলা হওয়া সম্ভব? নানা প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতি নিশ্চই অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত থাকবে না। টিকাও তো এসে যাবে শুনছি। ফলে আশা রাখছি খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারব।
শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় (ধানসিঁড়ি)
যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলা হতে পারে, তার থেকে ভালো তো কিছু হতে পারে না। যদি না হয় তাহলে অন্যভাবে ভাবতে হবে। এতদিন তো যথেষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেই কেটেছে। আগামীতে কী হয় দেখা যাক। এবছর শুরু থেকেই এত ব্যবসায়িক ক্ষতি সহ্য করা হয়েছে, তাতে বইমেলা হলেও আমরা কতটা অংশগ্রহণ করে উঠতে পারব, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বইমেলা না হলে যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে, সেটা তাও মানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু যদি বইমেলা এমনভাবে হয় যে সবার কাছে ঠিকভাবে বই পৌঁছোল না বা সবাই আসতে পারলেন না, তাহলে সেটা অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতিটা আমরা মানিয়ে নিতে পারব না।
সৌরভ মুখোপাধ্যায় (সপ্তর্ষি প্রকাশন)
পরিস্থিতি এখন এমনই যে গিল্ডও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না আদৌ বইমেলা হবে কিনা। আগামী ১২ তারিখ থেকে যদিও জেলায় জেলায় বইমেলা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু কলকাতা বইমেলা নিয়ে এখনও সরকারও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে বইমেলা না হলে যে একটা বড়ো ক্ষতি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক ক্ষতি তো বটেই, সেইসঙ্গে মানসিক ক্ষতিও। তবে বইমেলা হলেও যদি দেখা যায় মানুষ এলেন না ভয়ের চোটে, বা মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হল; সেক্ষেত্রে কোনো লাভ নেই। আর বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ কতটা মন খুলে বই কিনতে পারবেন, সেটাও বলা মুশকিল।
শান্তনু ঘোষ ও কৌশিক দত্ত (বুকফার্ম)
সারা পৃথিবীর সমস্ত বাণিজ্যিক ক্ষেত্রই করোনা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত। কলকাতার বই বিপণনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা জানাই ছিল। তবে সমস্ত ক্ষেত্রই যখন পরিস্থিতির সঙ্গে বদলাচ্ছে, তখন আমাদেরও বদলাতে হবে। আমরা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের বদলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। অনলাইন বিপননের পাশাপাশি সুইফট-বুকসের সঙ্গে মিলে এপ্রিল মাস থেকে শুরু করেছি ই-বুক প্রকাশ করা। আমাদের সমস্ত বই আমরা ই-বুকে নিয়ে এসেছি। বইমেলা হবে কিনা, সেই দোলাচল তো অনেকদিন ধরেই ছিল। ফলে প্রত্যেকেরই বিকল্প রাস্তা খুঁজে রাখা প্রয়োজন ছিল। এই নতুন বিকল্পও তো খুলে গিয়েছে করোনা পরিস্থিতির কারণেই।
আরও পড়ুন
কলকাতা বইমেলার প্রবেশদ্বারে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নকশা, চত্বরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি!
অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় (ধ্যানবিন্দু)
বইয়ের ব্যবসা তো এপ্রিল মাস থেকেই খুব খারাপ। যদিও শীতের শুরুতেই নানা মেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। জেলায় জেলায় বইমেলাও হচ্ছে। ফলে মনে হয় কলকাতা বইমেলাও হতে পারে। তবে একটা বিষয় মনে হয়, প্রকাশকদের এবং গিল্ডের যা বিনিয়োগ থাকে বইমেলার পিছনে, তাতে মানুষ না এলে সত্যিই অনেকটা ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। আর করোনা এবং আমফান মিলিয়ে ইতিমধ্যে যে ক্ষতির মুখে আমরা পড়েছি, তাতে আবার লোকসান করে বইমেলায় সামিল হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে গিল্ডের পক্ষ থেকেও সহজ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা মনে মনে এই ক্ষতিটা হবে ধরেই রেখেছি। অনলাইন বিপননেই তাই বেশি ভরসা রাখছি আমরা। দেখা যাক এরপর কী হয়।
রোহণ কুদ্দুস (সৃষ্টিসুখ)
বইমেলা তো আমাদের জন্য একটা বড়ো বাণিজ্যের জায়গা। বিশেষ করে আমাদের মতো ছোট প্রকাশকদের জন্য বইমেলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর যা বই বিক্রি হয় তার অনেকটাই বইমেলার উপর নির্ভর করে। ইতিমধ্যে সারা বছরে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে করোনার কারণে। তার সঙ্গে আমফানের প্রভাবও পড়েছে। ফলে বইমেলা যদি না হয় বা পিছিয়ে যায় তাহলে আমাদের জন্য একটা বড়ো ক্ষতি। অবশ্য শুনছি যে দেরিতে হলেও বইমেলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গিল্ডের তরফ থেকে আমাদের এখনও কিছু জানানো হয়নি। ফলে দুশ্চিন্তা তো থেকেই যাচ্ছে।
শূদ্রক উপাধ্যায় (ইতিকথা)
করোনা পরিস্থিতি থেকে আমরা তো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। জেলায় জেলায় বইমেলা শুরু হতে চলেছে। আশা রাখছি কলকাতা বইমেলা দেরিতে হলেও হবে। গিল্ডের পক্ষ থেকেও তো এমনটাই জানানো হচ্ছে। মনে হয় না এখনই নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকেই এগোচ্ছে যখন, নিশ্চই বইমেলাও সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন
কলকাতা বইমেলা হচ্ছেই, আশাবাদী গিল্ড; তারিখ নিয়ে সংশয় কাটল না বৈঠকেও
সেলিম মণ্ডল (তবুও প্রয়াস)
আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাচ্ছি। মেলা হবে সেই আশা নিয়েই আছি। এবছর এমনিতেই সবার বইয়ের সংখ্যা কম। ফলে লাভ-লোকসানের হিসাবটা হয়তো খুব বড় হবে না। তবে বইমেলায় একসঙ্গে অনেক বই বিক্রি হয়। তাছাড়া আমফানের ফলে বইপাড়ারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তবুও আশা হারানোর এখনই কোনো প্রয়োজন তো নেই।
Powered by Froala Editor