ভারত-চিন সীমান্তে উত্তেজনা সেই চলছেই। তার সঙ্গেই দেশের ভিতরেও চলছে অন্য একটা বিরোধিতা। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন গান্ধীজি। ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন করে ডাক দিয়েছিলেন দেশীয় দ্রব্য ব্যবহার করতে। সেই ব্রিটিশ আর নেই। তার বদলে স্বাধীন ভারতের বাজার ধরে নিয়েছে পড়শি দেশ চিন। দীর্ঘ সময় ধরেই ভারতে চিনা দ্রব্যের ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভারত-চিন সীমান্তে এলাকা দখল, সেনা সংঘর্ষ এবং তার প্রেক্ষিতে দুই দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মধ্যে কথার লড়াই সম্পূর্ণ অন্য মাত্রা দিয়েছে এই পরিস্থিতিকে। আচমকাই ১৩০ কোটি ভারতবাসীর ব্যক্তিগত তথ্য এবং দেশের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার স্বার্থে বেশ কয়েকটি ধাপে একাধিক চিনা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। বাতিল হয়েছে টিকটক, শেয়ারইট। এই তালিকাতে নবতম সংযোজন জনপ্রিয় মোবাইল গেম পাবজি।
কিন্তু ভারতের এই সিদ্ধান্তকে কখনোই ভালো চোখে দেখছে না চিন। বিপুল ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা মাথায় রাখলে, সেটা স্বাভাবিকও বটে। চিনের বাণিজ্য মন্ত্রকে তরফে বরাবরই ভারত সরকারের এই চিনা অ্যাপ বাতিলের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি সরাসরি এমনও বলা হয়েছে যে, চিনের বিরুদ্ধে আমেরিকা যেমন ‘ক্লিন নেটওয়ার্ক’ অভিযান শুরু করেছে, ভারত যেন ভুল করেও সেই রাস্তায় না হাঁটে।
বস্তুত চিনের তরফে স্বীকার করে নেওয়াই হয়েছে যে, ভারতের এমন সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে চিনা সংস্থাগুলি। তবে এর বিরোধিতা করতে গিয়ে অদ্ভুত একটি মন্তব্য করেছেন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চেনিং। চিনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং ভারতীয় যোগব্যায়াম বেশ জনপ্রিয়, কিন্তু তার জন্য চিন কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেনি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সুতরাং, পাবজি গেম নিয়েও ভারতের এই ভীতি ‘অকারণ’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে চিনা বিদেশমন্ত্রকের তরফে।
পাবজি গেমের সঙ্গে তুলনায় রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনা আশ্চর্যকরই বটে। ইতিহাস বলছে, ১৯২৪ সালে চিনদেশে পা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বামপন্থী চৈনিক তরুণেরা বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুষ্ঠানগুলোতে। তবে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের প্রতি মনোভাব বদলেছিল চিনের জনগণের। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে প্রবল মাতামাতি শুরু হয়েছিল চিনের সাহিত্য ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি চিনের সেই শ্রদ্ধা যে এতোটুকু টাল খায়নি এখনও, সেই কথাই বোধহয় বলতে চাইল চিনা প্রশাসন।
কিন্তু এই বক্তব্যের পিছনেও যে আসলে গভীর এক রাজনীতি তা বুঝতে পারার জন্য কোনও গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সচেতনভাবে এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার ও স্বার্থ লঙ্ঘনের বিষয়টিও। বাস্তবিকভাবেই, ভারতে পাবজি ব্যান হওয়ার পর থেকে সরকারের কাছে দেশেরই কেউ কেউ আবেদনও করেছেন যে অন্তত পাবজি গেমটি ব্যান না করার জন্য। সুতরাং যারা অন্যান্য চিনা অ্যাপ্লিকেশন বাতিল করার জন্য সরকারকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছিল, তাদের একটি বড় অংশ একটি নির্দিষ্ট চিনা অ্যাপ বাতিল হওয়াতে মুষড়ে পড়ছে, হায়, এতই ঠুনকো দেশপ্রেম? এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে ‘পাবজি’র বদলে আবার ভারতে চলে আসছে ‘ফৌজি’ গেম। বলিউড অভিনেতা অক্ষয় কুমার এই নতুন অ্যাকশন গেম লঞ্চ করার খবর জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনেতা লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আত্মনির্ভর ভারত তৈরি করার স্বপ্নে নতুন সংযোজন এই গেমটি। শুধুমাত্রই খেলা নয়, বরং তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশের সেনাদের আত্মত্যাগের কথাও হবে তুলে ধরা হবে এই ফৌজি গেমের মাধ্যমে। এছাড়াও এই গেম থেকে পাওয়া একটি লভ্যাংশ যাবে ভারতীয় সেনানীদের জন্য তৈরি করা একটি ট্রাস্টে।
কথা হচ্ছে আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন কি শুধুমাত্র মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে দেখা সম্ভব? বড় শিল্পের হদিশ নেই কোনও। চাকরি ক্ষেত্রে ভয়াবহ হাহাকার। কৃষক মৃত্যুর পরেই দেশে ভয়াবহভাবে বেড়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের আত্মহত্যার ঘটনা। এই সব বিষয়কে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মনির্ভর ভারতের নামে এই ধরনের বালখিল্যতা কতদিন চলবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
আরও পড়ুন
বাড়িতে বসে, বই খুলেই পরীক্ষা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া সিদ্ধান্ত ও কিছু সংশয়
সুতরাং, একনজরে যদি ঘটনাগুলি পর পর দেখা যায়, তাহলে একটা অন্যরকম ধাঁধা লাগতে কিন্তু বাধ্য। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে বাতিল করা হল চিনা অ্যাপ। সেই প্রেক্ষিতে চিন জানাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিনের সংস্কৃতির কাছে ব্রাত্য নয়। চিনা অ্যাপের বিকল্প হিসেবে নতুন মোবাইল অ্যাপ নিয়ে আসার কথা ঘোষণা হল দেশের ভেতর থেকেই। এ যেন চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’, বিড়ালের ‘শ’ রুমালের ‘মা’! অদ্ভুত রঙিন একটা ‘চশমা’ পরে দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে সবকিছু। পাবজি বনাম ফৌজির মধ্যে যেভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, এমন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির আড়ালে আসলে অন্যকিছু লুকিয়ে যাওয়া হচ্ছে না তো দেশবাসীর থেকে? অতিমারি পরিস্থিতি পেরিয়ে দেশের চাকরিক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্র এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্র ঘুরে দাঁড়াবে কবে, তার কোনও সঠিক দিশা নেই এখনও। তাই অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার অছিলায় নিজের দেশের দুর্দশার ছবি যেন পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া না হয়, সেটাই কাম্য।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পরীক্ষা নিতে অনড়, ফল প্রকাশে অনীহা : কেন্দ্রের ‘তুঘলকি’ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ দেশজুড়ে