একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। উত্তরপ্রদেশে সরকার চলছে নাকি জঙ্গলরাজ, তাই নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তুঙ্গে। একদিকে রাম জন্মভূমি প্রতিষ্ঠা নিয়ে মাতামাতি অন্যদিকে অসহায় এবং অসুরক্ষিত মহিলা সম্প্রদায়-- উত্তরপ্রদেশের একই মুদ্রার দুই পিঠ। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে এমন অনাচার বৃদ্ধির কারণটা ঠিক কী? প্রশাসনের অবহেলা? পুরুষতান্ত্রিকতার জয়ধ্বজা? নাকি, চিরাচরিত সেই ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ধর্ষণকে?
স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না উত্তরপ্রদেশের শাসক দল। বস্তুত পরিসংখ্যান বলছে যে, রাজ্যটির বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই প্রথম দু'মাসে রাজ্যে আটশোরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-এর তথ্যই জানাচ্ছে যে, বর্তমানে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ দেশের মধ্যে সবার আগে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন মহিলা ধর্ষিত হন উত্তরপ্রদেশে। যদিও স্বাভাবিকভাবেই এটা একান্তই সরকারি পরিসংখ্যান। বিভিন্ন সময় নানা জায়গা থেকে অভিযোগ উঠেছে, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ বহু ক্ষেত্রে আড়াল করছে অপরাধীদের। ফলে ধর্ষণের অভিযোগ আসলেও সেটা তালিকা ভুক্ত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানোর জায়গা অবধি পৌঁছতেই দেওয়া হয়নি সেটা। তাই আসল চেহারাটা আরো বেশি ভয়াবহ। তবে তার থেকেও বেশি ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে, এদের মধ্যে ৩৪ জনকে খুন করা হয়েছে ধর্ষণের পর। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ নতুন না হলেও, এই যে ধর্ষণের পর জিভ কেটে দেওয়া অথবা নৃশংসভাবে খুন করা— সেই নজির কিন্তু এত প্রকট ভাবে দেখা যায়নি আগে কখনও।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এর একটা নির্দিষ্ট কারণ হল, অপরাধীর মনে ঢুকে যাওয়া ভীতি। এর আগে অপরাধীরা ধর্ষণ করার পর মনেই করে নিত যে ধর্ষিতা মহিলা সম্মান রক্ষার্থে অথবা পারিস্পারিক চাপে কখনোই মুখ খুলবে না এর বিরুদ্ধে। কিন্তু বর্তমানে ছবিটা বদলেছে অনেকখানি। সব ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন নির্যাতিতারা। ফলে যে কোনও ভাবে তাদের মুখ বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। ফলত, কোথাও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে; কোথাও পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে। কামদুনি থেকে কাঠুয়া, সামশাবাদ থেকে হাথরাস - সব জায়গাতেই ছবিটা একই। যদিও ধর্ষণের কারণ হিসেবে কামোত্তেজনা অথবা যৌন চাহিদাকে দায়ী করতে পারছেন না অনুত্তমা। কারণ যৌন তাগিদ পূরণের ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্মতির অথবা সম্মানের প্রাধান্য থাকার কথা। কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে একমুখী এবং ক্ষমতার পেশি প্রদর্শনই এখানে মূল কথা। আমি পুরুষ; আমি যা কিছু করতে পারি মহিলাদের সঙ্গে— এই বক্তব্যই যেন ধর্ষণের মাধ্যমে দিতে চাইছে ধর্ষকেরা।
রীতিমতো ‘ক্যাটেগোরাইজেশান’ করে নিশানা করা হচ্ছে মহিলাদেরকে। ক্রমশই আরো বেশি ‘ভালনারেবল’ হয়ে উঠছে আদিবাসী, দলিত অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়েরা। অর্থাৎ জাত-পাত এবং ধর্মের ভিত্তিতে দুর্বল শ্রেণীর মহিলারা শিকারে পরিণত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকাও অবশ্যই প্রশ্নযোগ্য। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, কোনও রকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি সেখানে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট উল্লেখ করাই হয়নি ধর্ষণের ঘটনা। এক্ষেত্রে তাই চিকিৎসক থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন, সকলেরই ভূমিকা এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কয়েক মাস আগেই কুখ্যাত গ্যাংস্টারকে পাকড়াও করা এবং নিকেশ করার পর উত্তরপ্রদেশ পুলিশের নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল। এমনকি অনেক সাধারণ বাসিন্দাদেরও অভিমত, এই সরকারের আমলে অনেক কমেছে দুর্বৃত্তদের উৎপাত। কিন্তু তাহলে মহিলাদের সুরক্ষার দিতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে এই সরকার?
অনুত্তমার মতে, এখানেও প্রশ্নটা বিচার বা পছন্দের। অর্থাৎ কোন বিষয়টার সমাধান করব, কোনটা তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলে এই জাতীয় একটি ভেদাভেদও যেন তৈরি হয়ে গেছে কখন। ফলে নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য যেমন গ্যাংস্টারদের সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে তেমনি দলিত, আদিবাসী অথবা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে হয়তো মানুষের পর্যায়েই গণ্য করা হচ্ছে না। তাই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে মরছে সেই ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন
২ সপ্তাহ লড়াইয়ের শেষে মৃত্যু দলিত যুবতীর; কেন ধর্ষণ রুখতে বারবার ব্যর্থ উত্তরপ্রদেশ?
এক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকেও অনেকখানি দায়ী করা যায়। যৌন শিক্ষার পাঠ যেমন শিশু বয়স থেকেই ছেলে-মেয়েদের দেওয়া উচিত, তেমনই ডাক্তার অথবা পুলিশদেরও ‘সেনসিটাইজেশন’-এর প্রয়োজন। প্রয়োজন শেখা, আসলে সংবেদনশীলতার অভিমুখ কেমন হওয়া উচিৎ। এখনও আমাদের দেশে ধর্ষণের যে প্রথামাফিক সংজ্ঞা দেওয়া হয়, তার ফলে ছাড় পেয়ে যান অনেক অভিযুক্তই। এই যে যৌন সংযোগ না হলে তাকে ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে না, এই ধারণাটাতেই গলদ। অথচ ধর্ষণ যে শুধুই যৌনাঙ্গ নির্ভর হবে, তার কিন্তু আদতেই কোনো মানে নেই। তাই এক্ষেত্রে ডাক্তার অথবা পুলিশ প্রশাসনকেও শিক্ষিত করার আশু প্রয়োজন আছে। তাদেরকেও বুঝতে হবে যে, হিংসার ভাষা একরকম হয় না। ধর্ষণ করা যায় আরও অনেক ভাবেই। তাই শেখার প্রয়োজন আছে যৌনতার ভাষা। কোন ভাষায় সেটা ‘যৌনতা’ থেকে হয়ে দাঁড়ায় ‘যৌন হিংসা’, কোন ভাষায় হয়ে দাঁড়ায় ‘ভায়োলেন্স’ কিংবা কোন ভাষায় ‘ভায়োলেশন’, এই শিক্ষাটা খুবই দরকার।
তবে বর্তমানে সরকারের দিকে আঙুল উঠলেও এই সমস্যা কিন্তু উত্তরপ্রদেশের চিরকালীন। পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যায়, যোগী সরকার ক্ষমতায় আসার আগের শেষ দশ মাসে উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল তিন হাজারের কাছাকাছি। যোগী সরকার আসার ঠিক পরবর্তী ১০ মাসের মধ্যে সেই সংখ্যাটা বাড়লেও তাতে বিশাল কিছু পরিবর্তন হয়নি।
তাই এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া অসুখকেই দায়ী করা যায় এই লাগাতার ঘটে চলা অপরাধের জন্য। রাজনৈতিক দলের থেকেও যেখানে বেশি দায়ী পিতৃতন্ত্র। নইলে শুধুমাত্র পুরুষদের চোখ দিয়েই এই সমস্যাটাকে দেখা অথবা বিচার করা হত না এইভাবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুও সকলকে আশ্চর্য করে মন্তব্য করতেন না, লকডাউনের ফলে ছেলেদের বিয়ে হচ্ছে না বলেই এই সময় তীব্র হারে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের মতো ঘটনা!
আরও পড়ুন
ধর্ষণ কারা করে, কারাই বা বাঁচাবে, শাস্তিতেই সমাধান - উত্তর আসবে না?
সুতরাং একটা শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া প্রয়োজন। সেটা কীভাবে হবে তা হাতড়াতে বসলে হতাশা আসা স্বাভাবিক। হয়তো প্রথাগত লিঙ্গ সচেতনতা আসলেই এর বিরুদ্ধে পাঁচিল গড়ে তোলা যাবে। ভয়ের ব্যাপার হল, সেই সচেতনতা আসতে আসতে আরো কতগুলো মেয়ের জীবন এইভাবে আগুনের শিখায় অথবা পাথরের নিচে থেঁতলে শেষ হয়ে যাবে, তা কে বলতে পারে!
Powered by Froala Editor