সাইকোড্রামা— মন, মনোরোগী ও স্ক্রিপ্টহীন নাট্যত্রিভুজ

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির কথা, চিকিৎসা গ্রহণের কথা বলা হয় পৃথিবীর সব দেশেই। কিন্তু ব্রাজিলের বিখ্যাত মনোরোগবিদ বললেন ভিন্ন এক কথা। তাঁর মতে, ওষুধ সেবন ছাড়াও সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। সেই কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে, নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং মুক্তি পেতে পারে হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে। ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেইরো-র মনোরোগবিদ ড. রিতোর পর্দিয়োজ, মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য বেছে নিয়েছেন থিয়েটারকে। দীর্ঘদিন ধরে ‘নিজ দ্য সিলভিরা' মেন্টাল হেলথ ইন্সটিটিউটের রোগীদের নাটকে অভিনয় করানোর মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর নির্দেশনায় ২০ জন মানসিক রোগী সমুদ্রের তীরে শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে অভিনয় করেছেন। সঙ্গী আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আর ঢোল-তবলা। শেক্সপিয়ারের নাটক ছাড়াও মানসিক রোগীদের সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করান তিনি।

পর্দিয়োজ-এর মন্তব্য, ‘ড্রামা থেরাপি’র (Drama Therapy) কারণে মানসিক রোগীরা তাঁদের আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। অভিনয়ের দৃশ্য পাঠ করে নিজেদের অগ্রগতি সম্পর্কে মূল্যায়নও করতে পারেন তাঁরা। অন্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কীভাবে যোগাযোগ করা উচিত, সেই শিক্ষাও তারা উপলব্ধি করতে পারেন।

যাঁরা সিজোফ্রেনিয়া, ক্রনিক সাইকোসিস, হতাশায় ভোগেন; নাটকের মাধ্যমে তাঁরা অন্যের সঙ্গে নিজের আবেগ ও অনুভূতিকে সহজেই প্রকাশ করতে পারেন বলে বিশ্বাস পর্দিয়োজের। তিনি বলেন, মানসিক রোগীরা নাটকে অভিনয় করার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তার তৈরি করেন, সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পান।

 এ-বিষয়ে পর্দিয়োজের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারও যথেষ্টই। একসময়ে হাসপাতালে এমন কিছু রোগী আসতেন, যাঁরা প্রথমে ভালো করে কথাই বলতে পারতেন না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নাটকে অভিনয় করার ফলে এখন তাঁরা সাবলীলভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন। বাদ পড়েনি গানও। পর্দিয়োজের মতে, মানসিক রোগীর সুস্থতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে স্বাধীনভাবে, সংকোচ না করে কথা বলা। সেক্ষেত্রে নাটক তাঁদের জন্য সংলাপ তৈরি করার একরকম ‘থেরাপি’ হিসেবে কাজ করে। 

অন্যদিকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. লিওনার্দো পালমেরো মনে করেন, ড্রামা থেরাপি মানসিক রোগের জন্য সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই মাধ্যমকে একমাত্র পথ্য হিসেবে মনে করা উচিত নয়। কারণ মানসিক রোগ থেকে মুক্ত হতে যে-কোনো একটি উপায় অবলম্বন করে সফল হওয়া যায় না। তাই ওষুধ এবং কাউন্সেলিং গ্রহণ করাই তাঁদের জন্য বেশি লাভজনক।  

মানসিক রোগীকে থিয়েটারের মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর ধারণা প্রথম আবিষ্কার করেন নাট্যকর্মী ও পরিচালক অগাস্ট বোওযা়ল। ১৯৫০ সালে তিনি এ নিয়ে কাজ শুরু করেন ব্রেজিলে। এছাড়া মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ১৯২০ সালে ওসোরিও সিজার চিত্রশিল্পকে ‘থেরাপি’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ক্রমে এটি জার্মানি, লন্ডন, স্কটল্যান্ডেও জনপ্রিয়তা পায়।


• থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি

মহড়া ছাড়া ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আবেগ-কেন্দ্রিক তাৎক্ষণিক অভিনয় শৈলীই 'থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি', যার মধ্যে দিয়ে অভিনয়শিল্পী সৃজনশীল ও স্বতস্ফূর্তভাবে অভিনয় করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে 'আর্ট অব ইমপ্রোভাইজেশন' এই ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এই ধরনের থিয়েটারের প্রবক্তার জ্যাকব লিভি মোরিনো। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোরিনো যখন ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা মেডিকেল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন; তখন সেখানে অধ্যাপনা করতেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। এ সময় ফ্রয়েড তার সাইকোঅ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে পেয়েছিলেন কিছু মানুষকে, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোরিনো। কিন্তু মোরিনো পরবর্তীকালে ফ্রয়েড এর অনুসারী না হয়ে; বিপ্লবীর মতো ফ্রয়েডকে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন এই বলে যে, "ড. ফ্রয়েড, আপনার যেখানে সমাপ্তি আমার সেখানে শুরু। আপনি মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করেন; আর আমি তাদের পুনরায় স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহিত করি; শেখাই কীভাবে নিজেই নিজের স্রষ্টা হতে হয়। আপনি মানুষের সঙ্গে মেশেন আপনার অফিসে একটি কৃত্রিম পরিবেশে। আর আমি মেলামেশা করি তাদের বাড়িতে, রাস্তায় সর্বোপরি প্রকৃতির সংস্রবে।"

সৃজনশীলতাবর্জিত ও স্বতস্ফূর্ততাহীন অভিনয় ধারা মূলত 'হিমায়িত পণ্য' সমতুল্য। যদি এমন হত, পাণ্ডুলিপি নেই; চরিত্র নেই, কিন্তু নাট্যাভিনয় চলছে! তাহলে অভিনয়শিল্পী স্বতস্ফূর্ত এবং সৃষ্টিশীল অভিনিবেশ সহকারে তার নিজস্ব চিন্তা ও সমস্যার রূপায়ণ ঘটাচ্ছেন বলে মনে হত। তবে দর্শক কি ক্যাথারসিস মুক্ত থাকবে? দর্শনের ছাত্র হিসাবে এরিস্টটলের 'পোয়েটিকস'-এর আলোকে ক্যাথারসিস অভিধাকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করতে গিয়ে মোরিনো আবিষ্কার করেছিলেন যে, নাট্যাভিনয় উপভোগ করে দর্শক 'চরিত্রের' প্রতি একাত্ব হয় এবং নবতর ধারণা অর্জন করে। কিন্তু অভিনয়শিল্পী অভিনিত চরিত্রের সামগ্রিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হন না। প্রকারান্তরে অভিনয়শিল্পীর ওপর বিভিন্ন সময়ে অভিনীত চরিত্রের অন্তরাত্মার প্রভাব ভগ্নাংশ হিসেবে তাদের ভিতরে রয়ে যায়। যার প্রভাবে অভিনয়শিল্পীগণ প্রায়ই 'হিসট্রিওনিক নিউরোসিস'-এ ভোগেন, যা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনকে করে তোলে ভারসাম্যহীন।

জীবনের নাট্যমঞ্চে প্রত্যেক মানুষই 'ইমপ্রোভাইজিং অ্যাক্টর'। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মোরিনো ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনায় অভিনয়শিল্পীদের এই করুণ পরিণতি থেকে মুক্তি দিতে খুঁজছিলেন এমন একটি নতুন ও ভিন্ন কাঠামো; যার মধ্যে দিয়ে বিকাশ ঘটবে এমন এক থিয়েটারের, যেখানে গুরুত্ব পাবে সৃজনশীলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এবং তৈরি হবে মনের গভীরতম স্তরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। স্বাভাবিকের চেয়ে আরো বেশি জীবন্ত, সমৃদ্ধ ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ভোক্তা (অভিনয় শিল্পী) এবং উপভোক্তা (দর্শককুল)-এর জীবনকে সাবলীল করে তুলবে। অর্থাৎ বিকাশ ঘটবে 'থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি' ঘরানার। যে নাট্য ঘরানাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে মোরিনো ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনায় গড়ে তোলেন 'থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি'। 

১৯২২ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রমের মাধ্যমে মোরিনো যেমনি অভিনয়শিল্পীদের 'হিস্ট্রিওনিক নিউরোসিস' থেকে পরিত্রাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমনি থিয়েটারকে দিয়েছিলেন স্ক্রিপ্টের দাসত্ব থেকে মুক্তি। ইমপ্রোভাইজেশনাল থিয়েটার এসময় রূপান্তরিত হয় থিয়েটার অব থেরাপি হিসেবে। যার পরিণত রূপ হলে 'সাইকোড্রামা'।

প্রকৃতপক্ষে সাইকোড্রামা চেষ্টা করে সঙ্কটের কার্যকারণ খুঁজতে। এই প্রক্রিয়া অংশগ্রহণকারীদের শরীর, মন ও অন্তরাত্মাকে প্রসন্ন এবং প্রশান্ত করে। পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে জীবন অন্বেষণের উপায় উপস্থাপনের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের অপরাপর চরিত্রের বা ব্যক্তির সঙ্গে স্বতস্ফূর্ত ও যৌক্তিক জীবনাচারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে, দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়তা করে। ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্বতস্ফূর্ততাকে জাগ্রত করে সৃজনশীলতার বিস্তার ঘটানোই হচ্ছে সাইকোড্রামার মূল উদ্দেশ্যে।

Powered by Froala Editor