যে কোনো সরকারি ভবনের ছাদে প্রতিদিন দেখা যায় তাকে। গর্বিত মুখে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে সে। শিরদাঁড়া সোজা, বুক ফুলিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। হ্যাঁ, আমাদের জাতীয় পতাকা। স্বাধীনতার কত সংগ্রাম, কত রক্ত লেগে আছে এর সঙ্গে। জড়িয়ে আছে কত ইতিহাস— এভাবেই তো বেঁচে থাকে একটা আস্ত দেশ! এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত দৃশ্যই শাশ্বত, সনাতন হয়ে উঠে আসে। ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই পতাকারও একটি দীর্ঘ কাহিনি আছে। রয়েছে উত্থান-পতন। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছি আমরা। এগিয়েছে জাতীয় পতাকাও। আর সেই অমলিন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতা; জড়িয়ে আছে বাংলা…
আবেগ থেকে একটু ইতিহাসের বর্ণনায় নামা যাক। সভ্যতার বহমান ধারার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছিল ভারত। তার নানা সংস্কৃতি, নানা ধর্ম-বর্ণ। কত লোকে এসেছে, কত গেছে— সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। কিন্তু এক হয়ে থাকলেও, জাতীয়তাবাদ বা এক দেশের ধারণাটা সেভাবে সামনে আসেনি। সেইজন্য ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা কোনো জাতীয় পতাকার অস্তিত্ব পাব না। বদলে থাকবে বেশ কিছু রাজা-রাজড়াদের কাহিনি, নবাব-বাদশাদের কাহিনি। আর তাঁদের নিজস্ব কিছু চিহ্ন, বা পতাকা। সব ছিল আলাদা আলাদা। বহুত্বের মধ্যেও এক— এই ধারণাটা সেভাবে দাগ দেয়নি…
এরপর শুরু হয় ইংরেজ আমল। দেশ আস্তে আস্তে পরাধীনতার গ্রাসে চলে যায়। সেই সময় থেকে একটু একটু করে এই জাতীয়তাবাদ বিষয়টি সামনে আসতে থাকে। যার তীব্র বহিঃপ্রকাশ হয় সিপাহী বিদ্রোহের পর। আমরা পরাধীন, আমাদের দেশ পরাধীন, দেশকে স্বাধীনতা দিতে হবে— এই ভাবটা জনসমক্ষে উঠে আসতে থাকে। সবাইকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসাটা সত্যিই খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার জন্য দরকার একটি প্রতীকের। এই প্রথম জাতীয় পতাকার, বলা ভালো জাতির পতাকার ভাবনা শুরু হল।
১৮৮৩ সালে শ্রীশ চন্দ্র বসু নামের জনৈক বাঙালি ভদ্রলোক লাহোরে একটি মিছিল করেন। সেখানে দল-মত নির্বিশেষে তিনি ব্যবহার করেন একটি সূর্যের প্রতীক। সেটাই পতাকা করে বের হয়। কিন্তু এটা ঠিক জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়নি। তবে ভাবনাটা যে শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা বোঝা যায়…
আরও পড়ুন
সুইৎজারল্যান্ডের পাহাড়ে ফুটে উঠল ভারতের পতাকা, লকডাউনে সংহতির বার্তা
অতঃপর, ভারতে এলেন লর্ড কার্জন। এরপর যে ঘটনাগুলি ঘটে, তার সঙ্গে নতুন করে বলার অবকাশ নেই। বাংলা তখন বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র। লর্ড কার্জনের প্রথম লক্ষ্যই হল এই আন্দোলনের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া। সেই চিন্তা থেকেই ১৯০৫ সালে শুরু হল কাটাকুটির খেলা— বঙ্গভঙ্গ! গোটা বাঙালি জাতি ফেটে পড়ল। জাতিতে, ধর্মে বিভেদ তৈরি করে ইংরেজ সরকার ঠিক কাজ করছে না। আন্দোলন জোরদার হল, সঙ্গে শুরু হল স্বদেশী আন্দোলন। একই সঙ্গে প্রস্তুতি শুরু হল গোটা দেশকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার। কলকাতার অনুশীলন, যুগান্তর দলের ভেতর থেকেই আওয়াজ ওঠে, জাতীয় পতাকা তৈরি করা হোক।
আরও পড়ুন
৭১ হাজার টুথপিক দিয়ে তৈরি জাতীয় পতাকা, স্কুল শিক্ষকের কীর্তি
কাজও শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অরবিন্দ ঘোষও উদ্যোগ নিলেন। আর ডিজাইনের দায়িত্ব নিলেন শচীন্দ্র প্রসাদ বসু। এই পুরো কাজটাই হছিল কলকাতার পার্সিবাগান অঞ্চলে। শেষ পর্যন্ত তৈরি হল পতাকা। সবার সামনে তখন জ্বলন্ত উদাহরণ ফরাসি বিপ্লব। সেই ফ্রান্সের পতাকার অনুসরণেই ত্রিবর্ণরঞ্জিত করা হল। কিন্তু আজকের পতাকার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। কিন্তু এখানেও থেকে গেছে বিতর্ক। ঠিক কী রং ছিল পতাকার, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত। অনেকে বলেন একদম ওপরে ছিল সবুজ, তারপর হলুদ আর নিচে লাল (মতান্তরে কমলা)। ওপরে আটটি পদ্মফুল, আর নিচের লাল অংশের একদিকে সূর্য; অন্যদিকে একফালি চাঁদ। সব ধর্মের মিলন বোঝাতেই এই চিহ্নগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল। আর মাঝের হলুদ অংশে, দেবনাগরী হরফে লেখা ‘বন্দে মাতরম’।
আরও পড়ুন
‘আমরা বিভাজন চাই না’– দলীয় পতাকার বাইরে এসে ফের নিজেকে চিনিয়ে দিল কলকাতা
এই পতাকাই প্রথম জাতীয় পতাকা। অনেক ঐতিহাসিকও এই তত্ত্বটিকে স্বীকার করেন। ওই পরিস্থিতিতে এরকম একটি উদ্যোগ একেবারে অসম্ভব ছিল না। যাই হোক, ১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট, পার্সিবাগান অঞ্চলেই গ্রিয়ার পার্কে প্রথমবার এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলন করেন কলকাতার ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। পতাকাটির নামই হয়ে যায় ‘দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ’। মনে করা হয়, তখনকার এই গ্রিয়ার পার্কই আজকের সাধনা সরকার উদ্যান। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ঠিক বিপরীতেই যার অবস্থান…
আরও পড়ুন
স্বাধীন এই দেশে বাস করে মাত্র একটি পরিবারই, রয়েছে নিজস্ব পতাকা ও মুদ্রা
ঠিক এর পরের বছরই আরও একটি জাতীয় পতাকা আসে। সেটি তৈরি করেন মাদাম কামা। এর অনুপ্রেরণা কিন্তু ছিল ওই ক্যালকাটা ফ্ল্যাগই। কালে কালে আরও নানা রূপ বদলে আজকের গেরুয়া-সাদা-সবুজে এসে দাঁড়ায় ভারতের জাতীয় পতাকা। আর এই কাহিনির শুরুটা হয়েছিল এই শহরের বুকেই।
আরও পড়ুন
১৯৪৭-এ উত্তোলিত প্রথম জাতীয় পতাকা এখন কোথায় জানেন?
Powered by Froala Editor